আজকে আমরা আলোচনা করবঃ
মুরগির বাচ্চা পালনঃ
প্রধানত দুই উদ্দেশ্যে মুরগির বাচ্চা পালন করা হয়। যথা- ১। ডিম পাড়া মুরগির জন্য লেয়ার বাচ্চা এবং ২। মাংসের জন্য ব্রয়লার বাচ্চা পালন ।
- সাধারণত এক দিনের মুরগির ছানা পালন আরম্ভ করতে হয়।
- নিজ খামারে ইনকেউবেটরের মাধ্যমে ফুটানো মুরগির বাচ্চা অথবা সুনির্দিষ্ট মুরগির খামার থেকে এক দিন বয়সের প্রয়োজনীয় সংখ্যক লেয়ার বা ব্রয়লার বাচ্চা সংগ্রহ করে পালন করা যায়।
- আমাদের দেশে উল্লেখযোগ্য যে সকল মুরগির খামারে হ্যাচারীতে লেয়ার ও ব্রয়লার বাচ্চা বিক্রি করে তাদের ঠিকানা টেবিলে দেয়া হলো।
বাংলাদেশে লেয়ার ও ব্রয়লারের বাচ্চা সরবরাহকারী (হ্যাচারী) মুরগির ফার্মের তালিকাঃ
ক্র.নং | ফার্মের নাম ও ঠিকানা | লেয়ার ও ব্রয়লার স্ট্রেন |
১। | বিমান পোল্ট্রি কমপ্লেক্স, গনকবাড়ী, সাভার। | ট্রপিক ব্রো ব্রয়লার, স্টার ক্রস ব্রাউন লেয়ার। |
২। | এগস এন্ড হেনস লিঃ, কড্ড্ডা, জয়দেবপুর। | হাইব্রো ব্রয়লার, হাইসেক্স (সাদা/ব্রাউন) লেয়ার। |
৩। | ইউনাইটেড ফুড কমপ্লেক্স লিঃ, সারদাগঞ্জ, সাভার। | ইসা ভেডেট ব্রয়লার, ইসা ৪৫৭, ইসা ব্রাউন লেয়ার। |
৪। | ফিনিক্স পোল্ট্রি লিঃ, কোনাপাড়া, ধুনিয়া ।(বিক্রয় অফিস : ৩৪ পুরানা পল্টন, ঢাকা) | বি.ভি-৩০০/৩৮০, লোহমেনস ব্রাউন লেয়ার, বোবেনস ব্রাউন লেয়ার, হাবার্ড ব্রয়লার । |
৫। | ঊষা পোল্ট্রি ফার্ম লিঃ, বাইপাইল, ধানসোনা, সাভার। | ইসা ব্রাউন, ইসা ভেডেট ব্রয়লার। |
৬। | আফতাব বহুমুখী ফার্ম লিঃ, ৭৩ কাকরাইল, ঢাকা। | ইসা ১-৭৫৭, ইসা ব্রাউন লেয়ার। |
৭। | এম.এম. আগা লিঃ, ১৭৭ খাতুনগঞ্জ, চট্টগ্রাম। | হাবার্ড ব্রয়লার । |
৮। | কাজলী হ্যাচারী লিঃ, চন্দা, কালিয়াকৈর, গাজীপুর। | স্টার ক্রস ব্রাউন লেয়ার, স্টার ক্রস ৫৬৬ লেয়ার। |
৯। | সিলভার কার্প লিঃ, ১১৫-১২০ আদমজী কোট, ঢাকা। | ইসা ভেডেট ব্রয়লার, ইসা ব্রাউন লেয়ার। |
১০। | কেন্দ্রীয় মুরগির খামার, মিরপুর, ঢাকা। | লোহমেন ব্রাউন লেয়ার, আরবোর একর ব্রয়লার। |
এক দিন বয়সের মুরগির বাচ্চার লিঙ্গ নির্ণয়ঃ
বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লেয়ার পালনের জন্য এক দিন বয়সেই বাচ্চা পরীক্ষা করে লিঙ্গ নির্ধারণ করতে হয়। প্রধানত নিম্নোক্ত তিনটি পদ্ধতিতে এক দিনের বাচ্চার লিঙ্গ নির্ধারণ করা যায়।
১। বাচ্চার পালকের রং পরীক্ষা
→ সুতরাং নবজাত বাচ্চার বাপ-মায়ের রং জানা থাকলে শতকরা ১০০ ভাগ বাচ্চার লিঙ্গ সনাক্ত করা যায়।
যদি রঙীন জাতের মোরগের সাথে রংহীন মুরগি প্রজনন করা হয় তবে উৎপাদিত ডিম থেকে সেক্স → ক্রোমোজোমের কারণে সকল পুরুষ বাচ্চা মায়ের সদৃশ্য রংহীন এবং সকল স্ত্রী বাচ্চা বাপের সদৃশ্য রঙ্গীন হয়।
২। ভেন্ট সেক্সিং
→ পায়ু (Vent) হল অবসারণী (Cloaca)। পুরুষ বাচ্চার অবসারণীতে পেশীয় প্যাপিলা (Muscular papilla) থাকে কিন্তু স্ত্রী বাচ্চার কোন প্যাপিলা থাকেনা।
→ বাচ্চা জন্মের সময় থেকে ২-৩ দিন পর্যন্ত এই প্যাপিলা সুস্পষ্ট থাকে।
→সুতরাং এক দিনের মুরগির বাচ্চার পায়ুর প্যাপিলা পরীক্ষা করেই স্ত্রী বাচ্চা সনাক্ত করা যায়।
৩। উয়িং সেক্সিং
→পুরুষ বাচ্চার পালক খুব ধীরে গজায় এবং প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি পালক অপেক্ষা কার্ভাট পালক লম্বা থাকে।
→উয়িং সেক্সিংকে ‘ফেদার সেক্সিং’ বলা হয়। নবজাত মুরগির বাচ্চার ডানার প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি পালক পরীক্ষা করে স্ত্রী-পুরুষ বাচ্চা নির্ধারণ করার পদ্ধতির নাম ‘ফেদার সেক্সিং’।
→ অপরদিকে স্ত্রী বাচ্চার পালক অতি দ্রুত গজায় এবং কার্ভাট অপেক্ষা প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি পালক লম্বা থাকে।
সুবিধাসমূহ : প্রধানত নিম্নোক্ত কারণে ‘ভেন্ট সেক্সিং’ অপেক্ষা ‘ফেদার সেক্সিং’ ব্যবহার অধিক সুবিধাজনক।
→ চাপমুক্ত (stress free) বাচ্চা সরবরাহ করা যায়।
→ বাচ্চার লিঙ্গ নির্ধারণের জন্য অধিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তির প্রয়োজন হয় না।
→ বাচ্চার লিঙ্গ নির্ধারণের সঠিকতার হার অধিক হয়।
→ ‘ফেদার সেক্সিং’ পদ্ধতিতে বাচ্চার লিঙ্গ নির্ধারণ প্রায় নির্ভুল হয় বলে ঝুঁকি থাকেনা।
মুরগির বাচ্চা পালন পদ্ধতিঃ
মুরগি পালনের বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে বাচ্চার অধিক মৃত্যুর হার অন্যতম। তবে সুষ্ঠুভাবে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে বাচ্চা পালন করলে মৃত্যুর হার কম হয় এবং মুরগি পালন লাভজনক হয়।
সুতরাং মুরগির ছানার জন্মের পর থেকে ২ মাস বয়স পর্যন্ত বিশেষ যত্ন নিতে হবে।
প্রধানত দুই পদ্ধতিতে মুরগির ছানা পালন করা যায়। যথা- ১। প্রাকৃতিক পদ্ধতি এবং ২। কৃত্রিম পদ্ধতি ।
১। প্রাকৃতিক পদ্ধতি
→ স্বাভাবিক পদ্ধতিতে দেশী জাতের একটি মুরগি এক সাথে ১৫/১৬টির বেশী বাচ্চা পালন করতে পারে না। তবে এই পদ্ধতি দেশী জাতের মুরগির বাচ্চা পালন করাই ভাল।
→ বাচ্চাসহ মুরগিকে রাত্রে পৃথকভাবে রাখা প্রয়োজন। কারণ অন্য মোরগ-মুরগির সাথে রাখলে পরস্পরে মারামারি করে বাচ্চা মেরে ফেলতে পারে।
→ সাধারণত মুরগি নিজের তা দেয়া ফুটানো বাচ্চা ছাড়া অন্য বাচ্চাকে পালনের জন্য গ্রহণ করে না। তবে কৃত্রিম উপায়ে বিশেষ কৌশলের মাধ্যমে দেশী কুঁচে মুরগি দিয়ে পালা যায়। এক্ষেত্রে প্রথমে একটি দেশী কুঁচে মুরগিকে ১-২টি ডিম দিয়ে পাত্রে বসিয়ে দিতে হবে। দুই/তিন দিন পর রাত্রি বেলা কৃত্রিম উপায়ে ফুটানো এক দিনের বাচ্চা বা অন্য কোন মুরগির সদ্য ফুটানো বাচ্চা তার বুকের নিচে ছেড়ে দিলে সে তার নিজের বাচ্চা বলে গ্রহণ করে এবং পরদিন ডিম ছেড়ে বেরিয়ে আসে। এছাড়া কুঁচে মুরগিকে বসানো ডিম থেকে প্রথম বাচ্চা ফোটার রাত্রিতে কৃত্রিম উপায়ে ফুটানো বাচ্চাকেও বুকের নিচে দিয়ে দিলে মুরগি নিজের বাচ্চার ন্যায় পালতে থাকবে।
→ বাচ্চা জন্মের পর থেকে মুরগির সাহায্যে বাচ্চা পালন করার পদ্ধতিকে প্রাকৃতিক উপায়ে বাচ্চা পালন বলে। সাধারণত দেশী জাতের মুরগির এই পদ্ধতিতে বাচ্চা পালন করে থাকে। এই পদ্ধতিতে যতদিন বাচ্চার শরীরে নতুন পালক না গজায় ততদিন তারা নিজেদের দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তাই মাঝে মাঝে বাচ্চারা তার মায়ের পেটের বা ডানার নিচে অবস্থান করে দেহের প্রয়োজনীয় তাপ রক্ষা করে।
২। কৃত্রিম পদ্ধতি
→ বর্তমানে আমাদের দেশে প্রায় সব মুরগির খামারে কৃত্রিম পদ্ধতিতে মুরগির বাচ্চা পালন করা হয়। এছাড়া ব্যক্তিগত ভাবে অল্প বাচ্চা পালনের ক্ষেত্রে মুরগির ফার্ম থেকে এক দিনের বাচ্চা সংগ্রহ করে পালন করা যায়।
→ প্রধানত দু’ধরনের কৃত্রিম পদ্ধতিতে বাচ্চা পালন করা যায়। যথা- (ক) লিটার পদ্ধতি এবং (খ) কেইজ বা খাচায় ত্রুডিং ।
→ মুরগির সাহায্য ছাড়া জন্মের পর থেকে ৪-৬ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত মুরগির বাচ্চাকে সঠিক তাপমাত্রা, পরিমিত পানাহার প্রদানের মাধ্যমে বাচ্চার যত্ন ও সুব্যবস্থাপনায় পালনকে কৃত্রিম পদ্ধতি বলা হয়। জন্মের পর থেকে পাখির বাচ্চাকে ৫-৬ সপ্তাহ পর্যন্ত সময় কৃত্রিম উপায়ে তাপ দিয়ে পালন করাকে ত্রুডিং এবং যে ঘরে পালন করা হয় তাকে ব্রুডিং ঘর বলা হয়। আর যে যন্ত্রের সাহায্যে তাপ দেয়া হয় তাকে ব্রুডার বলে।
(ক) লিটার পদ্ধতির ব্রুডিং
→ বাচ্চা পালনের জন্য ত্রুডিং ঘরে ব্রুডার, চিক (ব্রুডার) গার্ড, ব্রুডার চুল্লি (হিটার), খাবার পাত্র, পানির পাত্র, বিছানা (লিটার), বাল্ব (হারিকেন), থার্মোমিটার, হাইগ্রোমিটার ইত্যাদি প্রয়োজন।
→ বাচ্চা সংগ্রহের নির্ধারিত তারিখের অন্তত এক সপ্তাহ পূর্বে ত্রুডিং ঘর ও বাচ্চা পালনের ব্যবহার্য সব যন্ত্রপাতি জীবাণুনাশক পদার্থ দিয়ে পরিষ্কার (ডেটল/আইসন) এবং প্রয়োজনে ফিউমিগেশন (১০০ বর্গ মিটার শেডের জন্য ফরমালিন ৩০% ১.৬ লিটার পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ০.৮ কেজি ও পানি ০.৮ লিটার) করতে হবে।
→ শেডে বাচ্চা আনার পূর্বে ত্রুডিং ঘরে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও উপকরণ যথাস্থানে স্থাপন করতে হবে।
→ বাচ্চারা যাতে এদিক ওদিক চলে না যায় সেজন্য প্রায় ৫০০টি বাচ্চা পালনের জন্য সাধারণত ৩.০৫ মিটার (১০ ফুট) ব্যাসের ঘরের পাকা মেঝে ৪৫-৬০ সেন্টিমিটার উচ্চতার হার্ড বোর্ড, টিন বা অন্য কোন বস্তু দ্বারা তৈরি গোলাকারবেষ্টনী বা ‘চিক গার্ড’ (ব্রুডার গার্ড) বসাতে হবে।
→ এই আবদ্ধকৃত ‘চিক গার্ড’ জায়গায় মেঝেতে ধানের তুষ, খড়ের কুচি অথবা কাঠের গুড়া দিয়ে ১০ সেন্টিমিটার পুরু বিছানা বা লিটার তৈরি করতে হবে।
→ একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্রুডিং ঘর ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত করা এবং ত্রুডিং ঘরের জায়গা (স্পেস) অনুযায়ী প্রয়োজনীয় এক দিনের বাচ্চা সংগ্রহের জন্য বাচ্চা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে বাচ্চা সংগ্রহের সঠিক তারিখ নির্ধারণ করতে হয়।
→ বাচ্চারা যদি চিক গার্ডের বেষ্টনী ঘেষে দলবদ্ধভাবে ঘুরতে থাকে ও কিমিচ্ শব্দ করে তবে বুঝতে হবে তাপ বেড়ে গেছে। এই অবস্থায় তাপ কমাতে হবে বা ব্রুডার বন্ধ করতে হবে।
→ বাচ্চাদের তাপ দেয়ার জন্য চিক গার্ডের মাঝখানে একটি ১.২২ মিটার (৪ ফুট) ব্যাসের ব্রুডার (প্রায় ৫০০ বাচ্চার জন্য) লাগাতে হবে। বাজারে বিভিন্ন ধরনের ব্রুডার পাওয়া যায়। যেমন- চতুষ্কোণী ইলেকট্রিক হিটার বা গ্যাস ব্রুডার, রাউন্ড ক্যানোপি হিটার বা গ্যাস ব্রুডার, ইনফ্রারেড ইলেকট্রিক ব্রুডার, হেরিকেন স্টোভ ইত্যাদি। সুতরাং প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করা যায়। তবে বৈদ্যুতিক বাল্ব ও ঢাকনা সহযোগে তৈরি ইলেকট্রিক ব্রুডারে বাচ্চাকে তাপ দেয়া যায়। এই পদ্ধতিতে ১০০ ওয়াটের ৩-৪টি বাল্ব দিয়ে ৩-৪ শত বাচ্চাকে তাপ দেয়া যায়।
→ বাচ্চা আসার ১২ ঘণ্টা পূর্বে শেডে ব্রুডার চালু করে ঘরের তাপমাত্রা ৯৫% ফাঃ করতে হয়। সাধারণত প্রথম সপ্তাহ ৯৫% ফাঃ থেকে আরম্ভ করে প্রতি সপ্তাহ ক্রমান্বয়ে ৫° ফাঃ করে তাপমাত্রা কমিয়ে স্বাভাবিক আবহাওয়ার সাথে খাপ খাওয়ায়ে দিতে হয়।
→ সাধারণত থার্মোমিটারের সাহায্যে ব্রুডার ঘরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করতে হয়। তবে চিক গার্ডের মধ্যে বাচ্চাদের অবস্থান দেখেও তাপমাত্রা ঠিক আছে কিনা বুঝা যায়।

→ ব্রুডারের নিচে বাচ্চা যদি গাদাগাদি হয়ে থাকে তবে বুঝতে হবে তাপমাত্রা কমে গেছে। এ অবস্থায় তাপ বাড়াতে হবে।
→ বাচ্চারা যদি চিক গার্ডের ভিতর সমভাবে ছড়িয়ে থাকে এবং স্বাভাবিকভাবে খাদ্য ও পানি গ্রহণ ও ঘোরাফেরা করে তবে বুঝতে হবে তাপমাত্রা স্বাভাবিক আছে।
→ তিন থেকে চার দিন পর কাগজের পরিবর্তে সুনির্দিষ্ট খাবার পাত্রে খাবার সরবরাহ করতে হবে। বাচ্চাদের সরবরাহের জন্য কাঠ, টিন, প্লাস্টিক, বাঁশ, মাটির তৈরি খাবার পাত্র ব্যবহার করা যায়। প্রতি ২৫টি বাচ্চার জন্য ৭৫ সেন্টিমিটার লম্বা, ৬০ সেন্টিমিটার চওড়া এবং ৫ সেন্টিমিটার উচ্চতা বিশিষ্ট ১টি করে খাবার পাত্র প্রয়োজন হয়।
→ সাধারণত মুরগির বাচ্চা জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাচ্চাদের খাওয়ার প্রয়োজন হয়না। তাই এই সময়ের মধ্যে বাচ্চা ক্রয় ও হ্যাচারী থেকে খামারে আনা সহজ হয়।
→ বাচ্চা খামারে আসার পর প্রথমে বিশুদ্ধ পানি খাওয়াতে হয়। তবে প্রথম দুই দিন বয়সে ১৬-২০° সেঃ তাপমাত্রার পানি খাওয়ানো প্রয়োজন। এছাড়া ১ম ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত প্রতি লিটার খাবার পানিতে ৫০ গ্রাম চিনি ভালভাবে মিশিয়ে খাওয়ানো ভাল ।
→ প্রথম ৩-৪ দিন বাচ্চার খাবার মোটা কাগজ বা চট অথবা বিশেষভাবে নির্মিত চিক ফিডারে দিতে হবে এবং প্রতি দিন সকালে ঝাড় দিয়ে না খাওয়া খাবার ফেলে দিতে হবে। একইভাবে পুনরায় কাগজে খাবার দিতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে খাবারের সাথে যেন লিটার না মিশে অথবা লিটারে খাবার না পড়ে।

→ পানির সরবরাহের জন্য লম্বা, গোলাকার টিনের প্লাক বা প্লাস্টিক অথবা মাটির তৈরি পাত্র ব্যবহার করা যায়। প্রতি ২৫টি বাচ্চার জন্য একটি করে পানির পাত্র দেয়া প্রয়োজন। বাচ্চাদের পানির পাত্রের গঠন এমন (ছোট আকৃতির) হওয়া উচিত যাতে বাচ্চা পানির পাত্রে পাত্রে পড়ে ভিজে না যায়।
→ ব্রুডিং এর বরাদ্দকৃত জায়গা প্রতি মাসেই ধীরে ধীরে বাড়াতে হবে। যদি ১ম মাসে প্রতি পাখির জন্য ০.০৫ বর্গ মিটার থেকে ২য় মাসে ০.১৪ বর্গ মিটার, ৩য় মাসে ০.১৯ বর্গ মিটার, ৪র্থ মাসে ০.২৩ বর্গ মিটার এবং ৫ম মাসে ০.২৮ বর্গ মিটার হিসেবে বাড়াতে হবে।

→ বাংলাদেশে পোল্ট্রির খাদ্যে প্রধানত খাদ্যশস্য (ভুট্টা, গম), প্রোটিন (সয়াবিন, তিলের খৈল, সরিষার খৈল, ধানের কুঁড়া, গমের ভূষি) এবং ফ্যাট (সয়াবিন তেল) থাকে।
→ বর্তমানে বাজারে বিভিন্ন বয়সের মুরগির খাদ্য পাওয়া যায়। সাধারণত প্রতিটি মুরগির বাচ্চা ১ম সপ্তাহে প্রতিদিন ১০ গ্রাম, ২য় সপ্তাহে ২০ গ্রাম, ৩য় সপ্তাহে ৩০ গ্রাম, ৪র্থ সপ্তাহে ৪০ গ্রাম হিসেবে খাদ্য গ্রহণ বৃদ্ধি পায়। সে অনুযায়ী ১০ সপ্তাহে প্রত্যহ ১০০ গ্রাম হিসেবে খাদ্য গ্রহণ করে। সুতরাং মুরগির সংখ্যা অনুযায়ী খাদ্য ক্রয় করতে হবে। তবে নিজে মুরগির খাদ্য তৈরি করে খাওয়ানোর জন্য একটি আদর্শ খাদ্যের তালিকা দেয়া হল।
→ লিটার স্যাতস্যাতে হলে ৪.৬ বর্গ মিটারের জন্য ০.৫ কেজি শুকনো চুন ছিটিয়ে দেয়া যায় এবং লিটার উল্টে পাল্টে দিতে হয়।
→ জন্মের পর থেকে বাচ্চার জন্য জীবাণুমুক্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও প্রয়োজনীয় রোগ প্রতিষেধক টিকার ব্যবস্থা করতে হবে।
→ পোল্ট্রি পালনের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ খরচ হয় খাদ্যের জন্য। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে প্রতিদিন ১২,০০০ মেট্রিক টন পোল্ট্রি খাদ্যের প্রয়োজন কিন্তু দেশের ১৫/১৬টি পোল্ট্রিক খাদ্য মিলে প্রত্যহ ৭০০ টন খাদ্য তৈরি হয়। তাই বেশীর ভাগ খাদ্য হাতের মাধ্যমে মিশিয়ে তৈরি করা হয়।
→ ব্রুডার ঘরে স্বাভাবিক বায়ু চলাচল, বাতাসের আর্দ্রতা (স্বাভাবিক ৫০-৬০%) নিয়ন্ত্রণ এবং আলো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন । ব্রয়লারের জন্য ব্রুডার ঘরে ২৪ ঘণ্টা আলো প্রয়োজন। আলোর ব্যবস্থায় পাখির খাদ্য গ্রহণ ও হজম ঠিকভাবে হয় এবং দৈহিক বৃদ্ধিসাধন ও উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
(খ) কেইজ বা খাঁচায় ব্রুডিং
→ প্রথমে তিন দিনের ৮০টি বাচ্চার জন্য ১ বর্গ মিটার জায়গা প্রয়োজন । এরপর ৩ সপ্তাহ বয়সে প্রতি বর্গ মিটারে বাচ্চার সংখ্যা কমিয়ে ৪৫-৫০টিতে আনতে হবে।
→ কেউজের গঠন ও বিন্যাস এমনভাবে হতে হবে যাতে বাচ্চারা পর্যাপ্ত তাপ, আলো ও বাতাস পায়। সহজে পানাহার ও চলাচল করতে পারে। ব্রুডিং কেইজের মেঝেতে ফাঁক না থাকাই ভাল ।
→ অবশিষ্ট বিষয় লিটার পদ্ধতির মতই ব্যবহার ও প্রয়োগ করতে হবে।
লেয়ার ও ব্রয়লার মুরগির জন্য সুষম খাদ্য তালিকাঃ
ক্র.নং. | খাদ্য উপাদান (%) | লেয়ার : স্টাটার (বাচ্চা (১-৩ সপ্তাহ) | লেয়ার : গ্রোয়ার (বাচ্চা) (১-৩ সপ্তাহ) | লেয়ার : (ডিম পাড়া) (১-৩ সপ্তাহ) | ব্রয়লার : স্টাটার (১-৪ সপ্তাহ) | ব্রয়লার : ফিনিসার (৫-৮ সপ্তাহ) |
১। | গম ভাঙ্গা | ৩৬.০ | ৩৪.০ | ৩৫.০ | ৪৭.০০ | ৫২.০০ |
২। | গমের ভূষি | ১০.০ | ১০.০ | ১০.০ | – | – |
৩। | চাল ভাঙ্গা | ১০.০ | ১০.০ | ১০.০ | – | – |
৪। | চালের কুড়া | ০৮.০ | ১৫.০ | ১০.০ | ২০.০০ | ১৮.০০ |
৫। | তিলের খৈল | ১২.০ | ১২.০ | ১২.০ | ১৩.০০ | ১২.০০ |
৬। | শুটকি মাছের গুড়া | ১৪.০ | ১০.০ | ১২.০ | ১৮.০০ | ১৫.০০ |
৭। | হাড়ের গুড়া | – | – | – | ০১.২৫ | ০১.০০ |
৮। | চিটা গুড় | ০২.০ | ০২.০ | ০২.০ | – | – |
৯। | ঝিনুকের গুড়া | ০২.০ | ০৩.০ | ০৮.০ | – | ০১.২৫ |
১০। | খেসারী সিদ্ধ | ০৫.০ | ৩.০ | – | – | – |
১১। | লবণ | ০০.৫ | ০০.৫ | ০০.৫ | ০০.৫০ | ০০.৫০ |
১২। | প্রিমিক্স* | ০০.৫ | ০০.৫ | ০০.৫ | ০০.২৫ | ০০.২৫ |
মোট | ১০০ | ১০০ | ১০০ | ১০০ | ১০০ |
* ভিটামিন-মিনারেল প্রিমিক্স।
মোরগ-মুরগি পালন পদ্ধতিঃ
প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম উপায়ে বাচ্চা পালন সম্পন্ন করার পরে আমাদের দেশে প্রধানত তিনটি পদ্ধতিতে মোরগ-মুরগি পালন করা হয়। যথা- ১। মুক্ত পালন, ২। আধাছাড়া অবস্থায় পালন এবং ৩। আবদ্ধ অবস্থায় পালন ।
১। মুক্ত পালন পদ্ধতি
→ এ পদ্ধতিতে পালনে খাবার খরচ কম লাগে তবে বিদেশি উন্নত জাতের মুরগি এ পদ্ধতি পালন অসুবিধাজনক। মুক্তভাবে পালিত মুরগি প্রতিবেশীকে বিরক্ত করে। শাক-সবজির ক্ষেত নষ্ট করে, ঘরের আঙ্গিনা বা উঠান নোংরা করে। মুরগি হারিয়ে যায় বা বন্য জন্তু মুরগি খেয়ে ফেলে। এছাড়া ডিম পাড়ার নির্দিষ্ট স্থান না থাকায় অনেক সময় ডিম পাওয়া যায় না বা ডিম ভেঙ্গে যায়।
→ ছাড়া অবস্থায় মোরগ-মুরগি পারলকে মুক্ত পালন পদ্ধতি বলা হয়। আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলে প্রধানত এই পদ্ধতিতে দেশী জাতের মোরগ-মুরগি পালন করা হয়।
→ এই পদ্ধতিতে মুরগি দিনের বেলায় স্বাধীনভাবে চরে বেড়ায় এবং রাতে ঘরে উঠে।
→ এই ব্যবস্থায় মুরগি ফেলে দেয়া এঁটো ভাত, পোকা-মাকড়, কচি ঘাস ইত্যাদি খাওয়ার সুযোগ পায় এবং অনেক সময় সামান্য কিছু খাদ্য দেয়া হয়।
→ মুক্তভাবে পালিত ১০-১৫টি মুরগিকে ১.৫০ × ১.২৫ মিটার মাপের একটি ছোট দো-চালা ঘরে রাত্রে রাখার ব্যবস্থা করা যায়।

২। আধাছাড়া অবস্থায় মুরগি পালন।
→ এই পদ্ধতিতে মুরগির ঘরের সামনে অল্প পরিসর খোলা জায়গা থাকে। খোলা জায়গাটি প্রায় ২ মিটার উঁচু তারের জাল বা বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে। (রান বা ব্যায়াম ঘর) দিতে হয়।
→ নির্দিষ্ট ঘেরা জায়গার মধ্যে মুরগির পালন ব্যবস্থাকে অর্ধমুক্ত বা আধাছাড়া অবস্থায় পালন বলা হয়।
→ ঘেরা জায়গায় খাদ্য ও পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। দিনের বেলায় এই ঘেরা জায়গায় মুরগি চরে বেড়ায়।
→ এই পদ্ধতিতে মুরগি প্রচুর সূর্যকিরণ পায়। তাই ভিটামিন-ডি এর অভাব হয়না। মুক্ত পালন পদ্ধতি অপেক্ষা এই পদ্ধতিতে মুরগির উৎপাদন বেশি হয়।
→ রাত্রে ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় থাকার জন্য মুরগির সংখ্যার উপর ভিত্তি করে একটি দো-চালা ঘর (ঢেউটিন, খড় বা ছনের তৈরি) রাখা হয়।
সাধারণত বছরে একবার ঘেরা জায়গার মাটিতে চুন প্রয়োগ করা প্রযোজ্য ।

৩। আবদ্ধ অবস্থায় মুরগি পালন
সম্পূর্ণ বদ্ধ অবস্থায় সীমাবদ্ধ জায়গায় মুরগিকে আবদ্ধ রেখে পালন করাকে আবদ্ধ অবস্থায় মুরগি পালন বলা হয়। প্রধানত দুই পদ্ধতিতে আবদ্ধ অবস্থায় মুরগি পালন করা হয়। যথা— (ক) ঘরের মেঝেতে পালন এবং (খ) খাঁচায় মুরগি পালন।
(ক) ঘরের মেঝেতে মুরগি পালন
ঘরের মেঝেতে সাধারণত দু’ভাবে মুরগি পালন করা হয়। যথা- (i) লিটার পদ্ধতি ও (ii) ডিপ লিটার পদ্ধতি।
(i) লিটার পদ্ধতি :
→ আবদ্ধ অবস্থায় পালিত মুরগির ঘরের মেঝেতে মলমূত্র শোষণকারী জৈব আস্তরণ বা বিছানাকে লিটার বলা হয়।
→ আমাদের দেশে সাধারণত ধানের তুষ, কাঠের গুড়া, শুকনো খড় বা গাছের পাতা চুর্ণ করে মুরগি পালনের জন্য লিটার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
→ মুরগি পালন সংখ্যার উপর ভিত্তি করে পাকা মেঝে বিশিষ্ট ঘর তৈরি করতে হয়।
→ গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রতিটি পুলেট মুরগির (হোয়াইট লেগ হর্ন) জন্য ০.১৬২-০.১৯০ বর্গ মিটার এবং প্রতিটি লেয়ার মুরগির জন্য ০.২৩২-০.২৮০ বর্গমিটার মেঝের জায়গা প্রয়োজন। উল্লেখ্য, প্রতিটি পাখির ১৬০০ বর্গ সেন্টিমিটার জায়গায় পালনে অধিক দৈহিক বৃদ্ধি ও ডিম উৎপাদন বৃদ্ধি পায় ।
→ সাধারণত এই লিটার পদ্ধতিতে ৫.০-৭.৫ সেন্টিমিটার পুরু করে বিছানা তৈরি করা হয়। এই লিটারের উপর মুরগি মলত্যাগ করে ফলে মলমূত্র মেঝের সাথে লেগে যেতে পারে না। এই পদ্ধতিতে প্রতি ২-৩ মাস পরপর মুরগির ঘরের লিটার পরিষ্কার করতে হয়।
(ii) ডীপ লিটার পদ্ধতি
→ সাধারণ লিটার পদ্ধতির মতই ডীপ লিটার পদ্ধতি। তবে ডীপ লিটার পদ্ধতিতে ঘরের মেঝেতে ১৫-২৩ সেন্টিমিটার পুরু বিছানা তৈরি করা হয়।
→ ডীপ লিটার পদ্ধতিতে ঘরে তেমন দুর্গন্ধ হয়না। ঘর শুষ্ক থাকে কারণ লিটার মলমূত্রের জলীয় অংশ চুয়ে নেয়। এছাড়া লিটার ঘন ঘন পরিষ্কার করার ঝামেলা থাকেনা। এমনকি ব্যবহৃত লিটার উৎকৃষ্ট জৈবসারে পরিণত হয়।
(খ) খাঁচায় মুরগি পালন
→ বেকার যুবক, গৃহিণী, অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি, ছাত্র-ছাত্রী সহজেই খাঁচায় লাভজনক ভাবে ডিম পাড়া মুরগি পালন করতে পারেন।
→ আমাদের দেশের আবহাওয়ায় প্রতিটি ডিম পাড়া মুরগি পালনের জন্য ৪৫ সেন্টিমিটার লম্বা, ৪৬ সেন্টিমিটার চওড়া ও ৪৫ সেন্টিমিটার উচ্চতা বিশিষ্ট খাঁচা তৈরি করতে হয়।
→ খাঁচার তলা বা মেঝে তারের জাল থাকে এবং তার নিচে থাকে টিনের ট্রে। ফলে মুরগি পায়খানা করলে সরাসরি ট্রেতে পড়ে। মুরগির খাঁচা ২-৪ তলা পর্যন্ত করা হয়। প্রতি তলায় খাঁচার জালের নিচে টিনের ট্রে থাকে। তাই ময়লা নিচ তলায় মুরগির গায়ে লাগেনা ।
→ খাঁচার তলা একটু সামনের দিকে ঢালু থাকে ফলে ডিম পারলে ডিম গড়িয়ে সামনের দিকে চলে আসে। লোহার তার, বাঁশের চটি অথবা কাঠের সাহায্যে খাঁচা তৈরি করে খাঁচার মধ্যে আবদ্ধ অবস্থায় মুরগি পালন ব্যবস্থাকে খাঁচায় মুরগি পালন বলা হয়।
→ এই পদ্ধতিতে মুরগির খাঁচা বারান্দায়, ছাদে অথবা ঘরের মধ্যে রেখে মুরগি পালন করা যায়।
→ নিয়মিতভাবে যেমন খাদ্য পানি সরবরাহ করতে হয় তেমনি নিয়মিতভাবে মলমূত্রের ট্রে পরিষ্কার করতে হয়।
→ এ পদ্ধতিতে মুরগিকে খাবার ও পানি দেয়া এবং ডিম সংগ্রহ করা সহজ। এই পদ্ধতিতে লাভজনকভাবে খাবার ডিম উৎপাদনের জন্য মুরগি পালন করা যায়।
→ খাঁচায় মোরগ বিহীন পালনকৃত মুরগির ডিম অনুর্বর হয় তাই খাঁচার ডিম সহজে পচেনা।
→ বাংলাদেশে শহর অঞ্চলে জায়গার অভাবে খাঁচায় মুরগি পালন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। খাঁচায় লিটার লাগেনা বলে খাঁচায় মুরগি পালনে খরচ কম হয়।
→ খাঁচার বাহির পার্শ্বে পানি ও খাবার পাত্রের ব্যবস্থা থাকে। এক্ষেত্রে মুরগি তারের ফাঁক দিয়ে গলা বের করে পানি ও খাদ্য গ্রহণ করে।

