দেহের মধ্যে মোরগ বা মুরগির কিছু অসঙ্গতিপূর্ণ ত্রুটি থাকলে সেটা যে বাতিল বলে গণ্য করা হবে তা ঠিক নয়। কারণ কিছু খুঁত থাকে যা সে প্রায় বংশ-পরস্পরায়। আবার কয়েক ধরনের খুঁত রয়েছে সেটা তার নিজস্ব।
আজকর পর্বের আলোচ্য বিষয়- বাছাইযোগ্য মোরগ-মুরগির লক্ষণ সমূহ কি? ভালো খারাপ মুরগি চেনার উপায় + বাজে মুরগি বাছাই ছাঁটাই কিভাবে করবেন?
প্রিয় খামারিয়াগণ আপনাদের জন্য নিয়ে আসলাম এই নতুন পর্বটি, যারা মুরগি পালন প্রশিক্ষণ সিরিজ অন্যান্য পর্গুবলো পড়েন নাই আশা করি কারা এই পর্ব শেষ করে অন্যন্য পর্বগুলো পড়ে নিবেন। হাতে সময় না থাকলে আমাদের ওয়েব সাইটি সেভ করে রাখুন যারে পরে পড়তে পারেন। চলুন শুরু করা যাক-
মুরগি পালন প্রশিক্ষণ সিরিজঃ বাছাইযোগ্য মোরগ-মুরগির লক্ষণ, ভালো খারাপ মুরগি চেনার উপায়ঃ

১. জাত এবং শ্রেণী
সিদ্ধান্ত নেবার আগে দেখতে হবে, কোন্ জাতের মুরগি সেই আবহাওয়ার সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে এবং স্থানীয় এলাকায় ডিম অথবা মাংসের মধ্যে কোন্ন্টার চাহিদা বেশি। কাজেই, খামার করার আগে নিজের আর্থিক সঙ্গতি বুঝে প্রথমে বাছতে হবে ভৌগোলিক ভাগ অনুসারে জাতি, নিজের প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে শ্রেণী পছন্দ, তারপর আর্থিক অবস্থার কথা চিন্তা করে মোরগ এবং মুরগির সংখ্যা ঠিক করা।
২. জন্মতারিখ
খামারের জন্যে মুরগি কেনার আগে প্রত্যেকটি মুরগির বয়স জানা দরকার। কারণ, বিভিন্ন সরকারী ও বে-সরকারী খামারে ১ দিনের বাচ্চা থেকে ৬ মাসের বাড়ন্ত বাচ্চা বিক্রি হয়। সাধারণভাবে ১ দিনের বাচ্চার যে দাম হয়, বয়স যত বাড়তে থাকে দামও সেই অনুপাতে বেড়ে যায়। মূলধন কম থাকলে ১ দিনের বাচ্চা এবং আর্থিক পরিস্থিতি ভালো হলে ৬ মাসের পরিণত বাচ্চাও কিনা যায়। বিদেশি উন্নত শ্রেণীর মুরগি ৬ মাসের পর থেকে ডিম দিতে শুরু করে। তবে মাংসের উদ্দেশ্যে খামার করলে ১ দিনের বাচ্চা কেনা উচিত।
৩. শরীর
- ভালো মুরগি বা মোরগের প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আকৃতি এবং গঠন লক্ষ্য করলে ভালো- মন্দের একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। এ বিষয়ে মাথার গড়ন, পা, স্বাস্থ্য, চোখ, চলার ভঙ্গী, মাথার ঝুঁটি, গলার ফুস, কানের লতি, চামড়ার রং, স্বভাব এবং শরীরের গড়ন প্রভৃতি দেখে মুরগি বাছাই করতে হয়। পিঠ সোজা, শরীর জমির সাথে সমান্তরাল গলা এবং লেজ সোজা এ সামান্য ঝুঁকে থাকবে সামনের দিকে। লেজের ক্ষেত্রেও তাই। যাদের লেজে পালক কম, সরু, পেছনের দিকে হেলানো তারা ডিম দেয়। মাথার গড়ন হবে গোল ও মোটা। যাদের মাথার গড়ন সরু, অনেকটা কাকের মতো লম্বা ধরনের তাদের থেকে বেশি ডিম পাওয়া যায় না।
- পা হবে ছোট, গঠনে সামঞ্জস্যপূর্ণ আঙুল এবং নখে কোন খুঁত থাকবে না। চোখ থাকবে বুদ্ধিদীপ্ত, দৃষ্টিও হবে তীক্ষ্ণ। বোকা-বোকা চাউনি, ঝিমুনি ভাব যাদের থাকে তারা কম ডিম দেয়। সর্বদা চঞ্চল, চটপটে ভাব। অকারণে সর্বদা মাটিতে আঁচড় কাটে না। খাবারের সন্ধানে সদাই ব্যস্ত। দানা ছড়িয়ে দিলে তাড়াতাড়ি কাবার জন্যে আগ্রহ দেখা যায়। এই ধরনের মুরগিই শরীরের মধ্যে বেশি ডিম গড়ে তুলতে পারে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা, নির্জীব ভাব দেখলে বুঝতে হবে স্বাস্থ্যের কোন ত্রুটি আছে। কাজেই, তাদের কাছ থেকে ভালো ডিম আশা করা যায় না।
- মাথার ঝুঁটি স্বাভাবিক এবং সম্পূর্ণ, রং উজ্জ্বল এবং হাত দিয়ে দেখলে নরম মোমের মতো মোলায়েম মনে হবে। যাদের অস্বাভাবিক গঠন, শক্ত এবং রং উজ্জ্বল, তারা কম ডিম দেবে। অবশ্য মাঝে মাঝে মুরগি সাময়িকভাবে ডিম পাড়া বন্ধ রাখে কিম্বা ঝুঁটির আকার ছোট হয়ে যায়। গলার ফুল ভরাট এবং রং উজ্জ্বল। মাথার ঝুঁটির সম্বন্ধে আগে যে সমস্ত কথা বলা হয়েছে গলার ফুলের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা বলা চলে।
- কানের লতি সুন্দর এবং তার মধ্যে কোন দোষ থাকবে না। পায়ের চামড়া এবং ঠোঁটের রং চকচকে ও মসৃণ। জননেন্দ্রিয় নরম, হাত দিলে ভিজে মনে হবে এবং দেখতে অনেকটা ডিমের মতো। জননেন্দ্রিয়ের দু -পাশের হাড়ের দূরত্ব থাকবে দুই, তিন অথবা চার আঙুলের কাছাকাছি। এই দূরত্ব যতটা বেশি হবে ততই ভালো লক্ষণ। স্বভাব হবে শান্ত এবং কিছুটা ভীরু প্রকৃতির। হাতে ধরে কোলের কাছে রাখলে বেশ শান্তভাবেই থাকবে। তবে ছেড়ে দিলে চঞ্চলতা লক্ষ্য করা যাবে। যে সমস্ত মুরগির মধ্যে আগের গুণগুলো দেখা যাবে কেবল তাদেরই পালনের জন্যে খামারে রাখা উচিত। বাকী সব মুরগি বাছাই করে খাবার জন্য রাখা চলে অথবা বাজারে বিক্রি করে দেওয়া দরকার।
৪. শরীরের খুঁত
এই খুঁত বলতে বোঝায় শরীরের অসঙ্গতিসমূহকে। এগুলো ধরতে পারা যায় যখন দেহের বিভিন্ন অংশের সাথে ভালোভাবে পরিচয় থাকে। আগেই মোরগ বা মুরগির ঝুঁটি এবং তার সাথে যে মাংসপিণ্ড থাকে সেটাই হলো তার ভেতরের দর্পণ। ভেতরের খুঁত ঝুঁটির রং দেখে বুঝতে পারা যায়।
মটর ঝুঁটিঃ কতকগুলো মটরের দানা পাশাপাশি সাজিয়ে রাখলে যেমন দেখায় অনেকটা সেই রকম দেখতে এবং এই ঝুঁটির মাঝখানটা সামান্য উঁচু, আসীল জাতের মুরগির মধ্যে এমন ঝুঁটি দেখতে পাওয়া যায়।
জোড়া ঝুঁটিঃ বিদেশি জাতের মধ্যে উইত্যানডট মুরগির এই ধরনের ঝুঁটি দেখা যায়। এর ওপরের অংশটা প্রায় চ্যাপ্টা থাকে রং এবং বাকী গড়ন সবই প্রায় এক।
একহারা ঝুঁটিঃ চিরুনি মতো ঝুঁটি, সংখ্যায় থাকে একটি এবং ঝুঁটির ধারে করাতের দাঁতের মতো খাঁজকাটা থাকে।
নিকৃষ্ট ধরনের ঝুঁটির দোষঃ আঙুলের ছাপ, এক ঝুঁটি-বিশিষ্ট মোরগের ঝুঁটি একদিকে হেলে পড়া, সাইড স্প্রিং, অসম দাঁত, মাঝখানে ঝুঁটির গর্ত, জড়ান অবস্থায় ঝুঁটি—এ সমস্ত বিশেষ খুঁত বলে ধরা হয়। মোরগ বা মুরগির ঝুঁটিতে এই দোষ থাকলে সেটা বংশগত বলে ধরা হয়।
দেহঃ মুরগি যে-কোন জাতের হোক না কেন, নিখুঁত এবং সুগঠিত হওয়া দরকার। দেহে নানা ধরনের খুঁত থাকে। তার মধ্যে পিঠের কুজতা এবং কীল নিচু হয়ে কোণের সৃষ্টি করে। এ বিষয়ে কেনার সময় সাবধান হওয়া দরকার।
চোখঃ কোটরাগত চোখ, শূন্য দৃষ্টি মুরগির শরীরে অনেক কিছুর ইঙ্গিত দিতে পারে। এটাও শরীরের খুঁতের মধ্যে পড়ে।
ডানাঃ মুরগির ডানা যদি ঝুলে পড়ে এবং দুটো ডানা যদি একসাথে জড়িয়ে যায় তবে কোনমতেই তাদের খামারে রেখে পালন করা উচিত নয়। কারণ, এই খুঁতটি বংশানুক্রমিক। এদের ডিম থেকে বাচ্চা ফোটালে এই খুঁত দেখা দেবেই।
লেজঃ মুরগির লেজ দেহের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে স্বাভাবিক হওয়া দরকার। সাধারণ নিয়ম অনুসারে মাথার ঝুঁটির সাথে কাল্পনিক রেখা টানলে ঠিক লেজে গিয়ে মিলে যাবে-অর্থাৎ ডান বা বাঁ দিকে হেলে থাকবে না।
পা ও পায়ের পাতাঃ পা দুটো ছোট, সরল এবং দেহের ভারসাম্য বজায়ে সক্ষম। পায়ের জন্যে যাতে দেহ সামনে বা পেছনে ঝুঁকে না থাকে এবং পায়ের পাতায় যাতে খাঁজ না থাকে তাও দেখা দরকার। চারটের জায়গায় পাঁচটা আঙুলওলা মুরগি ফার্মে পালনের পক্ষে ক্ষতিকারক।
৫. মাংসের পরিমাণ
যে সমস্ত মুরগিকে কেবলমাত্র মাংসের জন্যে পালন করা হয় তাদের শরীরে বংশগত খুঁত থাকলে সেটা সংক্রামিত হবার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে যারা মাংস এবং ডিমের জন্যে খামারে পালিত হচ্ছে তাদের ক্ষেত্রে খুঁত থাকলে তা বর্জন করাই ভালো।
৬. বাচ্চার স্বাস্থ্য
প্রকৃত খুঁত বলতে মুরগির শরীরে আমরা যা দেখতে পাই সেটা পূর্ণবয়স্ক মুরগি হলে তবেই ভালোভাবে ধরা সম্ভব। জন্মের দিন থেকে মুরগির শরীর পূর্ণতা লাভ করে কয়েকটি স্তরে।
→জন্মের দিন থেকে আট সপ্তাহ পর্যন্ত ওদের বলা হয় বাচ্চা বা চিকেন।
→আট সপ্তাহ থেকে ছাব্বিশ সপ্তাহ পর্যন্ত বাড়ন্ত বাচ্চা। ছাব্বিশ সপ্তাহ পার হলে ওরা ডিম পাড়তে শুরু করে। ওদের বলা হয় ‘তরুণ মুরগি’।
→দেড় বছর বয়সের পর মুরগির পূর্ণতা লাভ করে বিধখমওরা ‘হেন’ বা পূর্ণবয়স্ক মুরগি।
→মোরগের ক্ষেত্রে জন্মের দিন থেকে এক বছর বয়স পর্যন্ত বলা হয় বাচ্চা মোরগ। এর পর বয়স বাড়লে বলে ‘কক’ বা ‘পূর্ণাঙ্গ মোরগ’।
→মুরগির বাচ্চাকে ভালোভাবে পুষ্টিকর খাদ্য দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি হৃষ্টপুষ্ট করে মাংসের বাচ্চার নাম ‘ব্রয়লার’।
সাধরণভাবে সবল এবং ভালো বাচ্চার ডিম থেকে ফোটার পর ওজন থাকে ৪১ গ্রাম, ১ সপ্তাহ পার হলে ওজন বেড়ে দাড়ায় ৮২ গ্রাম এবং ৩ মাসের বাচ্চা জাত এবং ওজনের তারতম্য শ্রেণী অনুসারে ১ কেজি থেকে দেড় কেজি। গড়ে হিসেব করলে দাঁড়ায় প্রথম ওজনের থেকে ২৫ গুণের বেশি। ওজন কম হলেই বুঝতে হবে খাদ্য বা পালনের দোষ হচ্ছে, নতুবা শরীরে কোন রোগ আছে।

বাজে মুরগি বাছাই ছাঁটাইঃ
১. বাচ্চা ছাঁটাই
বাচ্চা অবস্থায় বাজে বাচ্চাগুলো ছাঁটাই করে বাদ দিলে খরচ অনেকাংশেই কমে। যেসব বাচ্চা নির্জীব ও বিকলাঙ্গ সেগুলোকে বাদ দিতে হয়। যে বাচ্চার তাড়াতাড়ি পালক গজায় সেগুলোকে রাখা উচিত। সাধারণতঃ ১২ সপ্তাহ বয়সে বাচ্চার দেহ পালকে ঢেকে যায়। বয়সেও যদি কোনোটির বেশি পালক না গজায় বা নেড়া দেখায় তা হলে ওগুলোকে বাদ দিতে হবে। ভালো বাচ্চার মাথার ঝুঁটি নরম ও লাল হয়। খারাপ বাচ্চার ঝুঁটি ছোট ও কোঁচকানো হয়। এরূপ ছোট কোঁচকানো ও ফ্যাকাসে বাচ্চাকে বাড় দিতে হয়।
২. কম ডিম পাড়া মুরগি ছাঁটাই
যে মুরগির বয়স অনুযায়ী ওজন কম, মাথার ঝুঁটি অপরিণত ও শুষ্ক এবং প্রসবদ্বারের দু পার্শ্বের পেলভিক হাড় দুটোর মধ্যে দুই আঙুলের কম ফাঁক থাকে তা থেকে বেশি ডিম পাবার আশা কম। তাই ডিম পাড়ার বয়সকালে (২২-২৪ সপ্তাহ বয়সে) বাজে মুরগি ছাঁটাই করে বিক্রি করে দিতে হয়। ভালো মুরগির মাথার ঝুটি ও গলার ফুল আকারে বড় ও লাল এবং পায়ের চামড়ার রং হলদে হবে। এই বয়সে দেহের ওজন হবে ১২০০ গ্রামের মতো। প্রসবদ্বারের পেলভিক হাড় দুটোর ফাঁক হবে ৩/৪ আঙুল। এইগুলো বেশি ডিম পাড়বে বলে কম ডিম পাড়া মুরগিগুলো বেছে বাছাই করতে হবে। ফার্মে রাখতে হবে। ডিম পাড়ার পর যদি দিন দিন ডিমের সংখ্যা কমতে থকে তা হলেও।
৩. পালক ছাড়া দেখে মুরগি ছাঁটাই
যে মুরগি যত অল্প সময়ে পালক ছাড়ে এবং নতুন পালক গজানো শেষ করে সে মুরগি তত ভালো। মোল্টিং-এর সময় ডিম পাড়া বন্ধ থাকে। মোল্টিং এর সময় কম লাগলে বেশি দিন ডিম পাড়বে। তাই যদি কোনো মুরগি ৩/৪ মাস ধরে কেবল পালকই ছাড়তে থাকে, এটিকে পাল থেকে বাদ দিতে হবে। সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে পালক ছাড়ার অবস্থা দেখে মুরগিগুলোকে বাছাই করতে হয়।
৪. ডিম উৎপাদনের হিসাব দেখে মুরগি ছাঁটাই
যদি ১০০টি মুরগি দৈনিক ৩০টিরও কম ডিম দেয় তবে সেই মুরগিগুলোর বেশির ভাগই খারাপ। এগুলোকে ছাঁটাই করে দেয়া ভালো।
৫. বেশি বয়সের মুরগি ছাঁটাই
বুড়ো মুরগির ঝুঁটি কর্কশ ও কোঁচকানো হয়। পালকগুলো বিবর্ণ ও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। তা ছাড়া পায়ের আঁইশগুলো বড় ও উঁচু নিচু হয়। ফার্মে এ জাতীয় বুড়ো মুরগি রাখা লোকসান। এসব বুড়ো মুরগি ছাঁটাই করতে হয়। সাধারণতঃ ডিম পাড়া শুরুর পর মুরগি এক বছর সর্বাপেক্ষা বেশি ডিম দেয়। মুরগির বয়স ১০ মাস হলেই ডিম পাড়া কমে যায়। সেজন্য ১৮ মাস বয়সের পর ফার্মের সব মুরগি বিক্রি করে নতুন স্টক আনতে হয়। তবে কোনো কোনো সংকর জাতের মুরগি ১৮ মাসের পরও শতকরা ৭০ ভাগ ডিম পাড়তে দেখা যায়। এইরূপ ক্ষেত্রে এদেরকে ফার্মে আরো কিছুদিন রাখা যেতে পারে।