প্রিয় ভাই-বোন. আপনার অনেকেই জানতে চেয়েছেন যে- মৃত ব্যাক্তির জন্য কুরআন খতম করা যাবে কি? বা মৃত ব্যাক্তির জন্য কুরআন খতম করা কি জায়েজ নাকি?
কোরআন জীবিতদের জন্য – মৃতদের জন্য নয়
আল্লাহ তাআলা এ সম্বন্ধে বলেন :
আমি তোমার প্রতি নাযিল করেছি এক বরকতময় কিতাব, যাতে তারা এর আয়াতসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং যাতে বুদ্ধিমানগণ উপদেশ গ্রহণ করে। (সূরা সোয়াদ ৩৮: আয়াত ২৯)
সাহাবাগণ কোরআনের হুকুম ও নিষেধের উপর আমল করতেন। একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করতেন। ফলে, তারা দুনিয়া ও আখিরাতের মধ্যে সৌভাগ্যশালী হয়েছিলেন। যখন থেকে মুসলিমরা এই কোরআনের শিক্ষা ও আমলকে ত্যাগ করে তাকে মৃতদের জন্য ও দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের জন্য ব্যবহার করতে শুরু করল, তখন থেকেই তাদেরকে অপমান ও লাঞ্ছনা স্পর্শ করল এবং তাদের মধ্যে বিভেদের সৃষ্টি শুরু হল। তাদের ক্ষেত্রে সত্যিই আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণী প্রযোজ্য,
আর রাসূল বলবে, হে আমার রব! নিশ্চয়ই আমার জাতি এ কোরআনকে পরিত্যাজ্য জ্ঞান করেছে। ( সূরা ফুরকান, ২৫: আয়াত ৩০)
আল্লাহ তাআলা একে অবতীর্ণ করেছেন জীবিতদের জন্যই। যাতে তারা তাদের জীবদ্দশায় তার উপর আমল করতে পারে। তা মৃতদের জন্য নয়। কারণ, তাদের আমলের রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে তারা আর তা পাঠ করতেও পারে না, আমলও করতে পারে না। কোরআন পাঠ করার কোনো সওয়াবও তাদের কাছে পৌঁছায় না। একমাত্র তার নেক সন্তানদের পাঠ করা ব্যতীত। কারণ সে তার ঔরসজাত সন্তান। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
মানুষ যখন মারা যায় তখন তিনটি ব্যতীত তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়, (১) সাদকায়ে জারিয়া, (২) এলম যার দ্বারা অন্যের উপকার হয় এবং (৩) নেক সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে। (মুসলিম)
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ
আর মানুষ যা চেষ্টা করে তাই সে পায়। (সূরা নাজম, ৫৩: ৩৯ আয়াত)।
ইবনে কাসীর রহ. তার তাফসীরে বলেন : তার উপর অন্যের পাপ যেমন অর্পিত হবে না, তেমনি অপরের সাওয়াবও সে পাবে না।
এই আয়াত থেকে ইমাম শাফেয়ী রহ. প্রমাণ বের করেন যে, কোরআন তেলাওয়াত করে তার সওয়াব মৃত্যুদের নামে উৎসর্গ করলে তা তাদের নিকট পৌঁছে না। কারণ, উহা তাদের আমল নয় অথবা উপার্জনও নয়। এই কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটাকে উম্মতের জন্য সুন্নত বানিয়ে যাননি, কিংবা তাদেরকে এ ব্যাপারে উৎসাহিতও করেন নি। অথবা সাহাবিরা কেউ এ ব্যাপারে কিছুই বলেননি। যদি এটা ভাল কাজ হত তাহলে অবশ্যই তারা তা করতেন।
মৃত ব্যাক্তির জন্য দোয়া, সদকা বা দান খয়রাতের সাওয়াব পৌঁছবে, এ ব্যাপারে কোনো মতবিরোধ নেই এবং এর দলীলও আছেঃ
১। আজ মৃত ব্যক্তির নিকট বসে কোরআন তেলাওয়াত করা একটা রসমে পরিণত হয়েছে। এমনকি কোনো বাড়ি থেকে কয়েকজনের মিলিত তেলাওয়াত শুনলে বুঝা যায় যে কেউ সেখানে মারা গেছে। যদি রেডিওতে সারাদিন কোরআন তেলাওয়াত শুনা যায় তাহলে বুঝতে হবে যে, কোনো নেতা মারা গেছে। (লেখক বলেন) একবার কোনো এক ব্যক্তি এক অসুস্থ বাচ্চাকে দেখতে যেয়ে কোরআন তেলাওয়াত করেন। তা শোনামাত্র বাচ্চার মা চেঁচিয়ে উঠে বলে : আমার বাচ্চাত এখনো মারা যায়নি, তাহলে তুমি কোরআন তেলাওয়াত করছ কেন?
২। যে ব্যক্তি জীবিত অবস্থায় সালাত ত্যাগ করেছে, তার জন্য মৃত্যুর পর কোরআন পাঠ করলে তার কি লাভ হবে? কারণ, তাকে তো আগেই আযাবের খবর দেয়া হয়েছে।
অতএব সেই সালাত আদায়কারীদের জন্য দুর্ভোগ, যারা নিজেদের সালাতে অমনোযোগী। ( সূরা মাউন, ১১৪: আয়াত ৪ও ৫)
৩। তোমরা মৃতদের উপর সূরা ইয়াসিন পাঠ কর’ মর্মে যে হাদিস বর্ণনা করা হয়, সেটি সহিহ নয় বরং মওজু বা জাল।
মুহাদ্দিস দারা কুতনী বলেছেনঃ এর সনদ দুর্বল এবং মূল বক্তব্যও দুর্বল।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা তাঁর সাহাবিদের কেউ মৃতের উপর কোরআন পাঠ করেছেন এমন কোনো প্রমাণ নেই। তারা না সূরা ইয়াসিন পাঠ করেছেন না সূরা ফাতেহা কিংবা কোরআনের অন্য কোনো অংশ। বরং নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবিদের বলতেনঃ
(দাফনের পর) তোমরা আপন ভাইয়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তার জন্য দৃঢ় ও অবিচলতার জন্য দোয়া কর। কারণ, তাকে এখন প্রশ্ন করা হবে। (আবু দাউদ)।
৪। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরে প্রবেশ করার সময় সূরা ফতিহা পাঠ করার শিক্ষা কাউকে দেননি। বরং তিনি এ দোয়া শিখায়েছেন :
হে ঘরের মুমিন-মুসলিম বাসিন্দাগণ! তোমাদের উপর আল্লাহর শান্তি বর্ষিত হোক। আমরাও আল্লাহ চাহে তো তোমাদের সাথে মিলিত হব। আল্লাহর কাছে আমাদের এবং তোমাদের জন্য তাঁর আযাব হতে ক্ষমা চাই। (সহিহ মুসলিম)।
এ হাদিস আমাদেরকে এ শিক্ষাই দিচ্ছে যে, মৃতদের জন্য আমরা দোয়া ও প্রার্থনা করব, তাদের কাছে দোয়া কিংবা সাহায্য প্রার্থনা করব না।
৫। জীবিতরা আমল করতে পারে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআন এ জন্যই নাযিল করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন :
যাতে তা সতর্ক করতে পারে ঐ ব্যক্তিকে যে জীবিত এবং যাতে কাফেরদের বিরুদ্ধে অভিযোগবাণী প্রমাণিত হয়। ( সূরা ইয়াসীন ৩৬: আয়াত, ৭০)