প্রিয় পাঠকবৃন্দ মৌমাছি পালন সিরিজ এর, আজকের পর্বে আলোচনা করব- মৌমাছির রোগ, চিকিৎসা ও প্রতিকার মৌমাছিদের রোগ ও তার দমন সম্পর্কে। .

আপনি যদি মৌমাছি বা মধু চাষ সম্পর্কে আগ্রহী হোন তাহলে মৌমাছি পালন সিরিজটি আপনার জন্যই সাজানো হয়েছে। আপনি পূর্বে সকল পোষ্টগুলো পড়তে পারেন।
তো চলুন আজকের আলোচনা শুরু করা যাক-
মৌমাছির অ্যাকারাইন রোগঃ
ইংরেজিতে এই রোগকে অ্যাকারাইন ডিজিজ বলে। বয়স্ক এবং শাবক উভয় বয়সের মৌমাছির এই রোগ দেখা দিতে পারে। তবে অবশ্য রোগের ধরন কিছুটা আলাদা হয়আশ্চাত্য দেশে এই রোগের প্রকোপ খুবই বেশি। অনেক সময় মহামারী আকারেও এর প্রাদুর্ভাব ঘটে।
মৌমাছির অ্যাকারাপিস উডি রোগঃ
ইংরেজিতে এই রোগকে অ্যাকারাপিস উড বলে। এক ধরনের অতি ক্ষুদ্র কীটাণু মৌমাছিদের বুকে অবস্থিত স্নায়ুনালী দিয়ে ঢুকে শ্বাসনালীতে ডিম পাড়ে। ওই ডিম লার্ভাতে পরিণত হবার পর হতে ধারালো মুখের সাহায্যে শ্বাসনালীর ভেতরকার মাংস খেতে শুরু করে। এইভাবে শ্বাসনালীর ফাঁকা জায়গা যখন অসংখ্য কীটাণুতে ভরে যায় তখন মৌমাছির শ্বাসরোধ হবার উপক্রম হয়।
অন্যদিকে শ্বাসনালীর দেয়াল ছিদ্র করার ফলে আক্রান্ত মাছির পা, পাখনা ইত্যাদির পেশিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত মৌমাছি চলার এবং উড়ে বেড়াবার ক্ষমতা হারিয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়।

মৌমাছির রোগের লক্ষণঃ
১. বহু মৌমাছি একসাথে চাকের সামনের দিকে হামাগুড়ি দিতে থাকে। কারণ তারা ওড়ার ক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে ফেলে।
২. উভয় পাশের পাখনা অবিন্যস্ত অবস্থায় থাকে এবং দেখতে অনেকটা ইংরেজি ‘কে’ এর আকার ধারণ করে।
৩. বটম বোর্ডের ভেতর ও বাইরে হলদে রং এর পায়খানা পড়ে থাকতে দেখা যায়।
৪. মৌমাছিদের পেট কিছুটা অস্বাভাবিক ফোলা বলে মনে হয় এবং পেট দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার উপক্রম হয়।
৫. হঠাৎ দেখলে মনে হবে মৌমাছিরা অলস হয়ে পড়েছে এবং তারা পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত।
৬. চাককে স্বাভাবিক নিয়মে ঢেকে না রেখে ইতস্ততঃ এবং বিক্ষিপ্তভাবে ছোট ছোট জটলা করে বসে থাকে।
মৌমাছির একই কলোনীর মধ্যে রোগের বিস্তারঃ
পূর্ণাঙ্গ স্ত্রী জাতীয় কীটাণু হেঁটে স্নায়ুনালীর ভেতর দিয়ে বাইরে এসে অন্য মৌমাছির গায়ে যাবার জন্য অপেক্ষা করে। ওই সময় কোনও সুস্থ মৌমাছি যখন আক্রান্ত মৌমাছির কাছ দিয়ে যায় তখন তারা সুস্থ মৌমাছির শরীরের প্রবেশ করে। কেবলমাত্র ৫-৬ দিনের কম বয়সের মৌমাছিরাই এই রোগের শিকার হয়। তাই যে কলোনীতে যত বেশি নতুন মৌমাছি জন্মাবে সেই কলোনীতে এই রোগের বিস্তার ঘটবে।
মৌমাছির এক কলোনী থেকে অন্য কলোনীতে রোগে বিস্তারঃ
পুরুষ মৌমাছি কুমারী রাণীর খোঁজে কলোনী থেকে অন্য কলোনীতে যখন যাতায়াত করে তখন সেই রোগ অন্য কলোনীতে ছড়িয়ে পড়ে। সুস্থ ও অসুস্থ কলোনীর মধ্যে রবিং ও ফাইটিং হলে রোগের বিস্তার ঘটার আশংকা থাকে।
অসুস্থ কলোনীর ঝাঁক ছাড়া মৌমাছিকে অতি সুস্থ কলোনীতে মিশিয়ে দেওয়া হলে এর মাধ্যমে রোগের বিস্তার হয়। আবার অজ্ঞাতভাবে যদি রোগাক্রান্ত কলোনীকে অন্য কোনও সুস্থ কলোনীর সাথে একত্রীকরণ করা হয় তাহলেও রোগ সংক্রমিত হতে পারে।

মৌমাছির রোগের চিকিৎসাঃ
এই রোগের চিকিৎসা তিনভাবে করা যায়। যেমন প্লো চিকিৎসা, মিথাইল সেলিসিলেট চিকিৎসা এবং ফেলবেক্স চিকিৎসা।
মৌমাছির ফ্লো চিকিৎসাঃ
- অ্যাকারাইন রোগের প্রাদুর্ভাব হলেই এই চিকিৎসায় সাহায্য নিয়ে উপকার হয়। তবে শরৎকালে শেষভাবে এবং বসন্তের প্রথমদিকে এই চিকিৎসা চালানো উচিত।
- প্রথমে ফরমুলা অনুসারে ফ্লো মিক্সচার তৈরি করতে হবে। এই ওষুধের মিশ্রণ অত্যন্ত দাহ্য এবং বিষাক্ত। সেই কারণে ব্যবহার করবার সময় খুবই সতর্ক হওয়ার দরকার।
- একটি সাধারণ শক্তি সম্পন্ন কলোনীতে ড্রাম ফ্লো মিক্সার একটি ফ্লানেল প্যাড-এর মধ্যে ঢেলে ক্রাউন বোর্ডের ফিডিং হোলের ওপরে উলটে রাখতে হবে। প্রতি একদিন অন্তর সেই প্যাডে অনুরূপ মাত্রায় ওষুধ প্রয়োগ করা দরকার।
- এইভাবে ক্রমাগত ৭ মাত্রা ওষুধ একনাগাড়ে ব্যবহার করতে হবে এবং ১৩ দিনের মাথায় সপ্তম মাত্রা দেবার পর ওই প্যাডটিকে সেই ক্রাউন বোর্ডের ওপর আরও তিন থেকে চারদিন রেখে দেওয়া ভালো।
মৌমাছির মিথাইল সেলিসিলেট চিকিৎসাঃ
- এই চিকিৎসা বছরের যে কোনও সময়ে এবং যে কোনও আক্রান্ত কলোনীতে চালানো যেতে পারে। প্রথমে ১৫ সি. সি. পেনিসিলিন বোতলে মিথাইল সেলিসিলেট দিয়ে ভর্তি করতে হবে। আর ওই বোতলের মুখে যে রবারের ছিপি আছে তার মাঝখানে একটা গরম পেরেক ঢুকিয়ে ছিদ্র বা ফুটো করে নিতে হবে।
- এবার ওই ছিপির ভেতর দিয়ে তুলো পাকানো একটা সলতের একদিক বোতলের ভেতর ঢুকিয়ে অন্য দিকটা বাইরে রাখতে হবে। এই বোতলটিকে বটম বোর্ডের ওপর বি-স্পেসের মাঝে এমনভাবে বসাতে হবে যেন চাকে বসানোর সময় বোতলটা উল্টে ওষুধ বটম বোর্ডে পড়ে মাছির কোনও ক্ষতি না করে।
- বোতলের মধ্যে ওষুধ সলতের সাহায্যে শোধিত হয়ে ধীরে ধীরে তার গন্ধ সারা কলোনীতে ছড়িয়ে দিলে রোগের উপশম হবে। এরপর বোতল খালি হয়ে গেলে আবার তাতে ওষুধ ভরে দেয়া দরকার।
মৌমাছির ফেলবেক্সে চিকিৎসাঃ
- সালফার মেশানো ফেলবেক্স নামে এক ধরনের টোটা বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। ওই টোটাতে আগুন লাগাবার পর যখন জ্বলে উঠবে তখন নিভিয়ে দিতে হবে। এর পরেই ওই টোটা থেকে কেবলমাত্র ধোঁয়া বের হতে থাকবে।
- আক্রান্ত মৌমাছির কলোনীতে একটি অতিরিক্ত সুপার চেম্বার চাপিয়ে ওই চেম্বারের দেয়ালে দোঁয়া বের হতে থাকা টোটাকে একটি পিনের মাধ্যমে ঝুলিয়ে দেওয়া দরকার। এই সময় হাইভের প্রবেশ পথ, বাতায়ন পথ সমস্ত বন্ধ করে দিতে হবে।
- সন্ধ্যার সময় সব মাছি যখন চাকে ফিরে আসবে তখনই ওই ওষুধ প্রয়োগ করার সব থেকে উৎকৃষ্ট সময়।
- অতিরিক্ত সুপার চেম্বারের দেওয়ালে ধোঁয়া বের হওয়া টোটা থাকবে ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট পর্যন্ত। এরপর হাইভের সব প্রবেশ পথ ও বাতায়ন পথ খুলে দিতে হবে। একইভাবে ক্রমান্বয়ে মোট সাত থেকে আট বার ওষুধ প্রয়োগ করার পর এক সপ্তাহ বাদ দেওয়া দরকার। এই ধরনের ধোঁয়া প্রয়োগে সাময়িকভাবে মৌমাছিদের সামান্য কিছু অসুবিধে হলেও চাকের জমানো মধু, পরাগ বা বাচ্চাদের কোনও ক্ষতির আশংকা থাকবে না। তবে আগুনের ফুলকি যাতে মাছিদের শরীরে না পড়ে তার জন্য টোটার ঠিক নীচে ব্রুড চেম্বারের টপ বারের ওপর ছোট একখণ্ড টিন পেতে রাখা ভালো।

মৌমাছির রোগ নির্ণয়ের জন্য নমুনা সংগ্রহঃ
- মৌমাছিদের রোগ ব্যাধির ক্ষেত্রে যে সমস্ত লক্ষণের কথা বলা হলো তা কলোনীতে দেখা মাত্রই ওই কলোনীর প্রবেশ পথ থেকে কমপক্ষে ২০টি সুস্থ, অসুস্থ ও মরা মাছি ধরে ৪ শতাংশ ফরমোরিন যুক্ত ১০ সি. সি. পেনিসিলিন বোতলে মাছিদের ছেড়ে দিতে হবে।
- এরপর বোতলের গায়ে লেবেল এঁটে তাতে মাছি সংগ্রহ করার তারিখ, জায়গার নাম, মৌমাছিপালকের নাম এবং সম্পূর্ণ ঠিকানা লিখে ছোট কাঠের বাক্সের মধ্যে প্যাক করে ল্যাবরেটরিতে পাঠাতে হবে।