⭐⭐⭐⭐⭐ বিষয়: যাকাতের বিধান ও মাসায়েল: কোন কোন সম্পদের উপর যাকাত ফরজ? যাকাত ফরজ হওয়ার শর্তসমূহ? যে সব অর্থ/সম্পদের যাকাত আসে না? যাকাত কিভাবে হিসাব করতে হয়? গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি প্রভৃতি প্রাণীর যাকাত? যাকাতের খাত? যাকাতের উপযুক্ত কারা? যাকাত আদায় আদায়ের নিয়ম (বিস্তারিত)
কোন কোন সম্পদের উপর যাকাত ফরজ?
* যদি কারও নিকট শুধু সোনা থাকে- রুপা, টাকা-পয়সা ও ব্যবসায়িক পণ্য কিছুই না থাকে, তাহলে সাড়ে সাত তোলা বা তার বেশী (সোনা) থাকলে বৎসরান্তে তার উপর যাকাত ফরয হয়।
* যদি কারও নিকট শুধু রুপা থাকে- সোনা, টাকা-পয়সা ও ব্যবসায়িক পণ্য কিছুই না থাকে, তাহলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা (রুপা) থাকলে বৎসরান্তে তার উপর যাকাত ফরয হয়।
* যদি কারও নিকট কিছু সোনা থাকে এবং তার সাথে কিছু রুপা বা কিছু টাকা-পয়সা বা কিছু ব্যবসায়িক পণ্য থাকে তাহলে এ ক্ষেত্রে সোনার সাড়ে সাত তোলা বা রুপার সাড়ে বায়ান্ন তোলা দেখা হবে না বরং সোনা, রুপা এবং টাকা-পয়সা ও ব্যবসায়িক পণ্য যা কিছু আছে সবটা মিলে যদি সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার যে কোন একটার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায়, তাহলে (বৎসরান্তে) তার উপর যাকাত ফরয হবে।
* যদি কারও নিকট শুধু টাকা-পয়সা থাকে-সোনা, রুপা ও ব্যবসায়িক পণ্য কিছু না থাকে, তাহলে সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার যে কোন একটার মূল্যের সমপরিমাণ (টাকা-পয়সা) থাকলে বৎসরান্তে তার উপর যাকাত ফরয হবে।
* কারও নিকট সোনা, রুপা ও টাকা-পয়সা কিছুই নেই শুধু ব্যবসায়িক পণ্য রয়েছে, তাহলে উপরোক্ত পরিমাণ সোনা বা রুপার যে কোন একটার মূল্যের সমপরিমাণ থাকলে বৎসরান্তে তার উপর যাকাত ফরয হবে।
* কারও নিকট সোনা, রুপা নেই শুধু টাকা-পয়সা ও ব্যবসায়িক পণ্য রয়েছে, তাহলে টাকা-পয়সা ও ব্যবসায়িক পণ্যের মূল্য মিলিয়ে যদি উক্ত পরিমাণ সোনা বা রুপার যে কোন একটার মূল্যের সমপরিমাণ হয় তাহলে বৎসরান্তে তার উপর যাকাত ফরয হবে।
যাকাত ফরজ হওয়ার শর্তসমূহ?
* আকেল (বুদ্ধিমান) বালেগ, ছাহেবে নেছাব মুসলমানের উপর বৎসরে একবার যাকাত আদায় করা ফরয। যে পরিমাণ অর্থের উপর যাকাত ফরয হয় তাকে বলে ‘নেছাব’ আর এ পরিমাণ অর্থের মালিককে বলা হয় ‘ছাহেবে নেছাব’। গরীব, পাগল ও না-বালেগের সম্পত্তিতে যাকাত ফরয হয় না।
* নেছাব পরিমাণ অর্থের উপর পূর্ণ এক বৎসর অতিবাহিত হলে যাকাত ফরয হয়। এক বৎসর অতিবাহিত হওয়ার পূর্বে যাকাত ফরয হয় না, যাকাতের ক্ষেত্রে ইংরেজী বা বাংলা নয় বরং চান্দ্র বৎসরের হিসাব করতে হবে।
* অর্থ সম্পদের প্রত্যেকটা অংশের উপর পূর্ণ এক বৎসর অতিবাহিত হওয়া শর্ত নয় বরং শুধু নেছাব পরিমাণের উপর বৎসর অতিবাহিত হওয়া শর্ত। কাজেই বৎসরের শুরুতে যে পরিমাণ ছিল (নেছাবের চেয়ে কম না হওয়া চাই) বৎসরের শেষে যদি তার চেয়ে পরিমাণ বেশী দেখা দেয় তাহলে ঐ বেশী পরিমাণের উপরও যাকাত ফরয হবে। এখানে দেখা গেল ঐ বেশী পরিমাণ যেটা বৎসরের মাঝে যোগ হয়েছে, তার উপর পূর্ণ এক বৎসর অতিবাহিত না হওয়া সত্ত্বেও তার উপর যাকাত আসছে।
* কেউ যদি বৎসরের শুরুতে মালেকে নেছাব হয় এবং বৎসরের শেষেও মালেকে নেছাব থাকে, মাঝখানে কিছু কম হয়ে যায় (নেছাবের ন্যুনতম পরিমাণের চেয়ে কমে গেলেও) তাহলে বৎসরের শেষে তার নিকট যে পরিমাণ থাকবে তার উপর যাকাত ফরয হবে। তবে মাঝখানে যদি এমন হয়ে যায় যে, মোটেই অর্থ সম্পদ না থাকে, তাহলে পূর্বের হিসাব বাদ যাবে। পুনরায় যখন নেছাবের মালিক হবে তখন থেকে নতুন হিসাব ধরা হবে এবং তখন থেকেই বৎসরের শুরু ধরা হবে।
যে সব অর্থ/সম্পদের যাকাত আসে নাঃ
* ব্যবসায়িক পণ্য ছাড়া ঘরে যে সব আবসাবপত্র, কাপড়-চোপড়, থালা- বাসন, হাড়ি-পাতিল, ফ্রিজ, আলমারি, শোকেজ, পড়ার বই ইত্যাদি থাকে তার উপর যাকাত আসে না।
* থাকা বা ভাড়া দেয়ার উদ্দেশ্যে যে ঘর-বাড়ী নির্মাণ করা হয় বা ক্রয় করা হয় কিংবা অনুরূপ উদ্দেশ্যে যে জমি ক্রয় করা হয় সে ঘর-বাড়ী ও জমির মূল্যের উপর যাকাত আসে না। তবে ব্যবসা/বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে ক্রয়কৃত বাড়ী ও জমির মূল্যের উপর যাকাত আসে।
* কারও কারখানা থাকলে এবং উক্ত কারখানায় কোন উৎপাদন হলে সে উৎপানের কাজে যে মেশিন যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র ব্যবহৃত হয়, মিল-ফ্যাক্টরীতে যে গাড়ী ও যানবাহন ব্যবহৃত হয় তার মূল্যের উপর যাকাত আসে না বরং যাকাত আসে উৎপাদিত মালামাল ও ক্রয়কৃত কাঁচামালের উপর।
* রিকশা, বেবী, টেক্সি, বাস, ট্রাক, লঞ্চ, স্টীমার ইত্যাদি যা ভাড়ায় খাটানো হয় অথবা যা দিয়ে উপার্জন করা হয় তার মূল্যের উপর যাকাত আসে না। অবশ্য এসব যানবাহনই যদি কেউ ব্যবসার (বিক্রয়ের) উদ্দেশ্যে ক্রয় করে থাকে তাহলে তার মূল্যের উপর যাকাত আসবে!
* পেশাজীবীরা তাদের পেশার কাজ চালানোর জন্য যে সব যন্ত্রপাতি ও আসবাব পত্র ব্যবহার করে থাকে তার মূল্যের উপর যাকাত আসে না। যেমন কৃষকের ট্রাক্টর, ইলেকট্রিশিয়ানদের ড্রিল মেশিন ইত্যাদি।
* যদি কারও নিকট ব্যবহারের উদ্দেশ্যে হীরা, মনি, মুক্তা, ডায়মও ইত্যাদির অলংকার থাকে, তাহলে তার মূল্যের উপর যাকাত আসে না। তবে এরূপ নিয়তে রাখা হলে যে, এটা একটা সঞ্চয়- প্রয়োজনের মুহূর্তে বিক্রি করে নগদ অর্থ অর্জন করা যাবে- এরূপ হলে তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে। (جواهر الفتاوی ج 1)
* প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের অর্থ হাতে পাওয়ার পূর্বে তার উপর যাকাত আসে না। তবে যে টাকাটা কর্তৃপক্ষ বাধ্যতামূলক নয় বরং চাকুরিজীবী স্বেচ্ছায় কর্তন করায় তার উপর যাকাত আসবে। এটা হল সরকারী চাকুরীর প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের মাসআলা। আর প্রাইভেট কোম্পানীর প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের টাকা হাতে পাওয়ার পূর্বেও তার যাকাত দিতে হবে। এমনিভাবে সরকারী চাকুরীর ক্ষেত্রেও চাকুরিজীবী যদি প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের টাকায় কোন ইন্সুরেন্স কোম্পানীতে অংশ নেয় তাহলেও তার যাকাত দিতে হবে।
* না-বালেগ ও পাগল-এর অর্থ/সম্পত্তিতে যাকাত আসে না।
যাকাত কিভাবে হিসাব করতে হয়?
* যে অর্থ/সম্পদে যাকাত আসে সে অর্থ/সম্পদের ৪০ ভাগের ১ ভাগ যাকাত আদায় করা ফরয। মূল্যের আকারে নগদ টাকা দ্বারা বা তা দ্বারা কোন আসবাব পত্র ক্রয় করে তা দ্বারাও যাকাত দেয়া যায়।
* যাকাতের ক্ষেত্রে চন্দ্র মাসের হিসেবে বৎসর ধরা হবে। যখনই কেউ নেছাব পরিমাণ অর্থ/সম্পদের মালিক হবে তখন থেকেই তার যাকাতের বৎসর শুরু ধরতে হবে।
* সোনা রুপার মধ্যে যদি ব্রঞ্জ, রাং, দস্তা, তামা ইত্যাদি কোন কিছুর মিশ্রণ থাকে আর সে মিশ্রণ সোনা রুপার চেয়ে কম হয় তাহলে পুরোটাকেই সোনা রুপা ধরে যাকাতের হিসেব করা হবে- মিশ্রিত দ্রব্যের কোন ধর্তব্য হবে না। আর যদি মিশ্রিত দ্রব্য সোনা রুপার চেয়ে অধিক হয়, তাহলে সেটাকে আর সোনা রুপা ধরা হবে না। বরং ঐ মিশ্রিত দ্রব্যই ধরা হবে।
* যাকাত হিসেব করার সময় অর্থাৎ, ওয়াজিব হওয়ার সময় সোনা, রুপা, বাবসায়িক পণ্য ইত্যাদির মূল্য ধরতে হবে তখনকার (ওয়াজিব হওয়ার সময়কার) বাজার দর হিসেবে এবং সোনা রুপা ইত্যাদি যে স্থানে রয়েছে সে স্থানের দাম ধরতে হবে।
* শেয়ারের মূল্য ধরার ক্ষেত্রে মাসআলা হলঃ যারা কোম্পানীর লভ্যাংশ (Dividend) অর্জন করার উদ্দেশ্যে নয় বরং শেয়ার ক্রয় করেছেন শেয়ার বেচা-কেনা করে লাভবান হওয়া (Capital Gain)-এর উদ্দেশ্যে, তারা শেয়ারের বাজার দর (Market Value) ধরে যাকাত হিসেব করবেন। আর শেয়ার ক্রয় করার সময় যদি মুল উদ্দেশ্য থাকে কোম্পানী থেকে লভ্যাংশ (Divdend) অর্জন করা এবং সাথে সাথে এ উদ্দেশ্যও থাকে যে, শেয়ারের ভাল দর বাড়লে বিক্রিও করে দিব, তাহলে যাকাত হিসেব করার সময় শেয়ারের বাজার দরের যে অংশ যাকাত যোগ্য অর্থ/সম্পদের বিপরীতে আছে তার উপর যাকাত আসবে, অবশিষ্ট অংশের উপর যাকাত আসবেনা। উদাহরণ স্বরূপ-শেয়ারের মার্কেট ভ্যালূ (বাজার দর) ১০০ টাকা, তার মধ্যে ৬০ ভাগ কোম্পানীর বিল্ডিং, মেশিনারিজ ইত্যাদির বিপরীতে, আর ৪০ ভাগ কোম্পানীর নগদ অর্থ, কাঁচামাল ও তৈরী মালের বিপরীতে, তাহলে যাকাতের হিসেব করার সময় শেয়ারের বাজার দর অর্থাৎ, ১০০ টাকার ৬০ ভাগ বাদ যাবে। কেননা সেটা এমন অর্থ/সম্পদের বিপরীতে যার উপর যাকাত আসে না। অবশিষ্ট ৪০ ভাগের উপর যাকাত আসবে।
* যাকাত দাতার যে পরিমাণ ঋণ আছে সে পরিমাণ অর্থ বাদ দিয়ে বাকীটার যাকাত হিসেব করবে। ঋণ পরিমাণ অর্থ বাদ দিয়ে যদি যাকাতের নেছাব পূর্ণ না হয় তাহলে যাকাত ফরয হবে না। তবে হযরত মাওলানা মুফতী তাকী উছমানী সাহেব বলেছেনঃ যে লোন নিয়ে বাড়ি করা হয় বা যে লোন নিয়ে মিল ফ্যাক্টরী তৈরি করা হয় বা মিল ফ্যাক্টরীর মেশিনারিজ ক্রয় করা হয়, এমনিভাবে যে সব লোন নিয়ে এমন কাজে নিয়োগ করা হয় যার মূল্যের উপর যাকাত আসে না -যেমন বাড়ি ও ফ্যাক্টরী বা ফ্যাক্টরীর মেশিনারিজের মূল্যের উপর যাকাত আসে না- এসব লোন যাকাতের জন্য বাধা নয় অর্থাৎ, এসব লোনের পরিমাণ অর্থ যাকাতের হিসাব থেকে বাদ দেয়া যাবে না। হাঁ যে লোন নিয়ে এমন কাজে নিয়োগ করা হয় যার মূল্যের উপর যাকাত আসে; যেমন লোন নিয়ে ফ্যাক্টরীর কাচামাল ক্রয় করল (এখানে কাঁচামালের মূল্যের উপর যাকাত আসে) এরূপ ক্ষেত্রে এ লোন পরিমাণ অর্থ যাকাতের হিসাব থেকে বাদ যাবে। মুফতী তাকী উছমানী সাহেব এ মাসআলাটিকে শক্তিশালী যুক্তি দ্বারা প্রমাণিত করেছেন, অতএব তার মতটি গ্রহণ করার মধ্যেই সতর্কতা রয়েছে।
* কারও নিকট যাকাত দাতার টাকা পাওনা থাকলে সে পাওনা টাকার যাকাত দিতে হবে। পাওনা তিন প্রকার (এক) কাউকে নগদ টাকা ঋণ দিয়েছে কিংবা ব্যবসায়ের পণ্য বিক্রি করেছে এবং তার মূল্য বাকী রয়েছে। এরূপ পাওনা কয়েক বৎসর পর উসূল হলে যদি পাওনা টাকা এত পরিমাণ হয় যাতে যাকাত ফরয হয়, তাহলে অতীত বৎসর সমূহের যাকাত দিতে হবে। যদি একত্রে উসূল না হয়- ভেঙ্গে ভেঙ্গে উসূল হয়, তাহলে ১১ তোলা রুপার মূল্য পরিমাণ হলে যাকাত দিতে হবে। এর চেয়ে কম পরিমাণ উসূল হলে তার যাকাত ওয়াজিব হবে না- তবে অল্প অল্প করে সেই পরিমাণে পৌঁছে গেলে তখন ওয়াজিব হবে। আর যখনই ওয়াজিব হবে তখন অতীত সকল বৎসরের যাকাত দিতে হবে। আর যদি এরূপ পাওনা টাকা নেছাবের চেয়ে কম হয় তাহলে তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে না। (দুই) নগদ টাকা ঋণ দেয়ার কারণে বা ব্যবসায়ের পণ্য বাকীতে বিক্রি করার কারণে পাওনা নয় বরং ঘরের প্রয়োজনীয় আসবাব পত্র, কাপড়-চোপড়, চাষাবাদের গরু ইত্যাদি বিক্রয় করেছে এবং তার মূল্য পাওনা রয়েছে- এরূপ পাওনা যদি নেছাব পরিমাণ হয় এবং কয়েক বৎসর পর উসূল হয় তাহলে ঐ কয়েক বৎসরের যাকাত দিতে হবে। আর যদি ভেঙ্গে ভেঙ্গে উসূল হয় তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্য পরিমাণ না হবে ততক্ষণ যাকাত ওয়াজিব হবে না। যখন উক্ত পরিমাণ উসূল হবে তখন বিগত বৎসর সমূহের যাকাত দিতে হবে। (তিন) মহরের টাকা, পুরস্কারের টাকা, খোলা তালাকের টাকা, বেতনের টাকা ইত্যাদি পাওনা থাকলে এরূপ পাওনা উসূল হওয়ার পূর্বে যাকাত ওয়াজিব হয় না। উসূল হওয়ার পর ১ বৎসর মজুদ থাকলে তখন থেকে তার যাকাতের হিসাব শুরু হবে। পাওনা টাকার যাকাত সম্পর্কে উপরোল্লিখিত বিবরণ অনুযায়ী হিসাব শুরু হবে। পাওনা টাকার যাকাত সম্পর্কে উপরোল্লিখিত বিবরণ শুধু তখনই প্রযোজ্য হবে যখন এই টাকা ব্যতীত তার নিকট যাকাত যোগ্য অন্য কোন অর্থ/সম্পদ না থাকে। আর অন্য কোন অর্থ/সম্পদ থাকলে তার মাসআলা উলামায়ে কেরাম থেকে জেনে নিবেন।
* যে ঋণ ফেরত পাওয়ার আসা নেই-এরূপ ঋণের উপর যাকাত ফরয হয় না। তবে পেলে বিগত সমস্ত বৎসরের যাকাত দিতে হবে।
* যৌথ কারবারে অর্থ নিয়োজিত থাকলে যৌথভাবে পূর্ণ অর্থের যাকাত হিসাব করা হবে না বরং প্রত্যেকের অংশের আলাদা আলাদা হিসাব হবে। (ইসলামী ফিকাহঃ ১ম)
* যে সব সোনা রুপার অলংকার স্ত্রীর মালিকানায় দিয়ে দেয়া হয় সেটাকে স্বামীর সম্পত্তি ধরে হিসাব করা হবে না বরং সেটা স্ত্রীর সম্পত্তি। আর যে সব অলংকার স্ত্রীকে শুধু ব্যবহার করতে দেয়া হয়, মালিক থাকে স্বামী, সেটা স্বামীর সম্পত্তির মধ্যে ধরে হিসাব করা হবে। আর যেগুলোর মালিকানা অস্পষ্ট রয়েছে তা স্পষ্ট করে নেয়া উচিত। যে সব অলংকার স্ত্রীর নিজস্ব সম্পদ থেকে তৈরী বা যেগুলো বাপের বাড়ি থেকে অর্জন করে সেগুলো স্ত্রীর সম্পদ বলে গণ্য হবে। মেয়েকে যে অলংকার দেয়া হয় সেটার ক্ষেত্রেও মেয়েকে মালিক বানিয়ে দেয়া হলে সেটার মালিক সে। আর শুধু ব্যবহারের উদ্দেশ্যে দেয়া হলে মেয়ে তার মালিক নয়। নাবালেগা মেয়েদের বিবাহ-শাদী উপলক্ষে তাদের নামে যে অলংকার বানিয়ে রাখা হয় বা নাবালেগ ছেলে কিংবা মেয়ের বিবাহ-শাদীতে ব্যয়ের লক্ষ্যে তাদের নামে ব্যাংকে বা ব্যবসায় যে টাকা লাগানো হয় সেটার মালিক তারা। অতএব এগুলো পিতা/মাতার সম্পত্তি বলে গণ্য হবে না এবং পিতা/মাতার যাকাতের হিসাবে এগুলো ধরা হবে না। আর বালেগ সন্তানের নামে শুধু অলংকার তৈরী করে রাখলে বা টাকা লাগালেই তারা মালিক হয়ে যায় না যতক্ষণ না সেটা সে সন্তানদের দখলে দেয়া হয়। তাদের দখলে দেয়া হলে তারা মালিক, অন্যথায় সেটার মালিক পিতা/মাতা।
* হিসাবের চেয়ে কিছু বেশী যাকাত দিয়ে দেয়া উত্তম। যাতে কোন রূপ কম হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে। প্রকৃত পক্ষে সেটুকু যাকাত না হলেও তাতে দানের ছওয়াবতো হবেই।
গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি প্রভৃতি প্রাণীর যাকাত
* গরু, বলদ, মহিষ, ঘোড়া, খচ্ছর প্রভৃতি প্রাণী ক্ষেত খামারের কাজে বা গাড়ী টানার জন্য অথবা বোঝা বহনের নিমিত্তে প্রতিপালন করা হলে তার উপর যাকাত ওয়াজিব হয় না।
* গরু, ছাগল, মহিষ প্রভৃতি চতুষ্পদ প্রাণী ব্যবসার নিয়তে ক্রয় করলে অর্থাৎ, ক্রয় করার সময় স্বয়ং ঐ প্রাণী বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে ক্রয় করলে সেগুলো ব্যবসায়িক পণ্য বলে গণ্য হবে এবং সেগুলোর মূল্য যাকাতের হিসাবে আসবে। যাকাত আদায় করার দিন তার যে মূল্য সেই মূল্য ধরা হবে। ক্রয় করার সময় যদি বিক্রয়ের নিয়ত না থাকে পরে বিক্রয়ের নিয়ত হয় কিংবা মূলটা রেখে তার বাচ্চা বিক্রয়ের নিয়ত থাকে বা পরে এরূপ নিয়ত হয়, সে সব ক্ষেত্রে সেগুলো বাণিজ্যিক পণ্য বলে গণ্য হবে না এবং তার উপর যাকাত আসবে না।
* গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ যদি দুধের জন্য অথবা বংশ বৃদ্ধির জন্য কিংবা শখ বশতঃ পালন করা হয়, তাহলে তাতে যাকাত আসে; তবে সেগুলোতে যাকাত আসার শর্ত হল সেগুলো ‘সায়েমা’ হতে হবে অর্থাৎ, সেগুলোর বেশীর ভাগ সময়ের খাদ্য বা বেশীর ভাগ খাদ্য নিজেদের দিতে হয় না বরং ময়দান জংগল ও চারণভূমির ঘাসপাতা ও তৃণলতা খেয়ে জীবন ধারণ করে, তাহলে তার উপর যাকাত আসে। তবে এরূপ ছাগল, ভেড়া অন্ততঃ ৪০টা এবং গরু, মহিষ ৩০টার কম হলে তার উপর যাকাত আসে না। সাধারণতঃ আমাদের দেশে এরূপ গরু ছাগল ইত্যাদি পাওয়া যায় না, তাই তার যাকাতের পরিমাণ ও বিস্তারিত বিবরণ পেশ করা থেকে বিরত রইলাম। আমাদের দেশের গরু মহিষের ফার্মে গরু মহিষকে নিজেরা খাদ্য দিতে হয় তাই সেগুলো সায়েমা নয়। অতএব দুধের উদ্দেশ্যে বা বংশ বৃদ্ধির জন্য সেগুলো পালন করলেও তার উপর যাকাত আসবে না।
* হাঁস, মুরগি যদি ডিমের উদ্দেশ্যে বা তার বাচ্চা বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে পালন করা হয়, তাহলে সেই হাঁস মুরগির উপর যাকাত আসে না। তবে হাঁস মুরগি বা তার বাচ্চা ক্রয়ের সময় যদি স্বয়ং সেটাকেই বিক্রি করার নিয়তে ক্রয় করা হয় তাহলে সেটা বাণিজ্যিক পণ্য বলে গণ্য হবে এবং তার মূল্যের উপর যাকাত আসবে।
* বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে মাছ চাষ করা হলে সেই মাছ বাণিজ্যিক পণ্য বলে গণ্য হবে এবং তার মূল্যের উপর যাকাত আসবে।
কোন কোন লোকদেরকে বা কোন কোন খাতে যাকাত দেয়া যায় না বা যাকাতের খাত
নিম্নলিখিত লোকদেরকে বা নিম্নলিখিত খাতে যাকাত দেয়া যায় না, দিলে যাকাত আদায় হয় না।
১। যার নিকট নেছাব পরিমাণ অর্থ/সম্পদ আছে।
২। যারা সাইয়্যেদ অর্থাৎ, হাসানী, হুসাইনী, আলাবী, জা’ফরী ইত্যাদি।
৩। যাকাত দাতার মা, বাপ, দাদা, দাদী, পরদাদা, পরদাদী, পরনানা, পরনানী ইত্যাদি উপরের সিঁড়ি।
৪। যাকাত দাতার ছেলে, মেয়ে, নাতি, নাতনি পোতা, পৌত্রী, ইত্যাদি নীচের সিঁড়ি।
৫। যাকাত দাতার স্বামী বা স্ত্রী।
৬। অমুসলিমকে যাকাত দেয়া যায় না।
৭। যার উপর যাকাত ফরয হয়-এরূপ মালদার লোকদের নাবালেগ সন্তান।
৮। মসজিদ, মাদ্রাসা বা স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল প্রভৃতি নির্মাণ কাজের জন্য।
৯। মৃত ব্যক্তির দাফন-কাফনের জন্য বা মৃত ব্যক্তির ঋণ ইত্যাদি আদায়ের জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যায়না।
১০। রাস্তা-ঘাট, পুল ইত্যাদি নির্মাণ ও স্থাপন কার্যে- যেখানে নির্দিষ্ট কাউকে মালিক বানানো হয় না- সেখানে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যায়না।
১১। সরকার যদি যাকাতের মাসআলা অনুযায়ী সঠিক খাতে যাকাতের অর্থ ব্যয় না করে, তাহলে সরকারের যাকাত ফাণ্ডে যাকাত দেয়া যাবে না।
১২। যাকাত দ্বারা মসজিদ মাদ্রসার স্টাফকে (গরীব হলেও) বেতন দেয়া যায়না।
যে লোকদেরকে যাকাত দেয়া যায় বা যাকাতের উপযুক্ত কারা?
১। ফকীর অর্থাৎ, যাদের নিকট সন্তান-সন্ততির প্রয়োজন সমাধা করার মত সম্বল নেই অথবা যাদের নিকট যাকাত ফেরা ওয়াজিব হওয়ার পরিমাণ অর্থ সম্পদ নেই।
২। মিসকীন অর্থাৎ, যারা সম্পূর্ণ রিক্ত হস্ত অথবা যাদের জীবিকা অর্জনের ক্ষমতা নেই।
৩। ইসলামী রাষ্ট্র হলে তার যাকাত তহবিলের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ।
৪। যাদের উপর ঋণের বোঝা চেপেছে।
৫। যারা আল্লাহর রাস্তায় শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদে লিপ্ত 1
৬। মুসাফির ব্যক্তি (বাড়িতে সম্পদশালী হলেও) সফরে রিক্ত হস্ত হয়ে পড়লে।
৭। যাকাত দাতার ভাই-বোন, ভাতিজা-ভাতিজী, ভগ্নিপতি, ভাগনা-ভাগনী, চাচা-চাচী, খালা-খালু, ফুপা-ফুফী, মামা-মামী, শ্বাশুড়ী, জামাই, সৎ বাপ ও সৎ মা ইত্যাদি (যদি এরা গরীব হয়)।
৮। নিজের গরীব চাকর-নওকর বা কর্মচারীকে দেয়া যায়। তবে এটা বেতন বাবদ কর্তন করা যাবে না।
যাদেরকে যাকাত দেয়া উত্তম
১। দ্বীনী ইল্ম পড়নেওয়ালা এবং পড়ানেওয়ালা যদি যাকাতের হকদার হয়, তাহলে এরূপ লোককে যাকাত দেয়া সবচেয়ে উত্তম।
২। তারপর যাকাত পাওয়ার সবচেয়ে যোগ্য নিজের আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে যারা যাকাত পাওয়ার যোগ্য তারা।
৩। তারপর বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশীর মধ্যে যারা যাকাত পাওয়ার যোগ্য তারা।
৪। তারপর যাকাতের অন্যান্য প্রকার হকদারগণ।
যাকাত আদায় আদায়ের নিয়ম ও মাসায়েল
* বৎসর পূর্ণ হওয়ার সাথে সাথে যাকাত আদায় করতে হবে। বিনা ওজরে বিলম্ব করলে পাপ হবে।
* যাকাত আদায় করার সময় নিয়ত করতে হবে যে, এ সম্পদ আল্লাহর ওয়াস্তে যাকাত হিসেবে প্রদান করা হচ্ছে, নতুবা যাকাত আদায় হবে না।
* নেছাবের মালিক হওয়ার পর বৎসর পূর্ণ হওয়ার পূর্বেও অর্থাৎ, যাকাত ওয়াজিব হওয়ার পূর্বেও অগ্রিম প্রদান করা যায়।
* যাকাত প্রদানের সময় গ্রহণকারীকে একথা জানানো প্রয়োজন নেই যে, এটা যাকাতের টাকা। আপনজনকে যাকাত দিলে তাকে একথা না বলাই শ্রেয়, কেননা বললে তার খারাপ লাগতে পারে।
* যে পরিমাণ টাকা থাকলে কারও উপর যাকাত ফরয হয়- এত পরিমাণ যাকাতের টাকা একজনকে দেয়া মাকরূহ। তবে ঋণী ব্যক্তির ঋণ মুক্তির জন্য বা অধিক সন্তান-সন্ততি ওয়ালাকে এত পরিমাণ দিলেও ক্ষতি নেই।
* যাকাত দেয়ার নিয়তে কোন টাকা পৃথক করে রাখলে পরে দেয়ার সময় যাকাতের নিয়তের কথা মনে না আসলেও যাকাত আদায় হয়ে যাবে।
* যাকে যাকাত দিবে অন্ততঃ এত পরিমাণ দিবে যেন ঐ দিনের খরচের জন্য সে আর অন্যের মুখাপেক্ষী না হয়। কম পক্ষে এত পরিমাণ দেয়া মোস্তাহাব, এর চেয়ে কম দিলেও যাকাত আদায় হয়ে যাবে।
* কারও নিকট টাকা পাওনা থাকলে যাকাতের নিয়তে সেই পাওনা মাফ করে দিলে যাকাত আদায় হবে না বরং তার নিকট যাকাতের টাকা দিয়ে পরে তার নিকট থেকে ঋণ পরিশোধ বাবদ সে টাকা নিয়ে নিলে যাকাতও আদায় হবে ঋণও উসূল হবে।
* যাকাতের টাকা নিজের হাতে গরীবদেরকে না দিয়ে অন্য কাউকে উকীল বানিয়ে তার দ্বারা দিলেও যাকাত আদায় হবে।
* যাকাত ওয়াজিব হওয়ার পর কেউ নিজের সমস্ত মাল দান করে দিলে তার যাকাত মাফ হয়ে যায়।
* যাকাত দাতার অনুমতি ছাড়া অন্য কেউ তার পক্ষ থেকে যাকাত দিয়ে দিলে যাকাত আদায় হবে না।
* যাকাত দাতা কাউকে পুরস্কার বা ঋণের নামে কিছু দিল আর অন্তরে নিয়ত রাখল যে, যাকাত হতে দিলাম, তবুও যাকাত আদায় হয়ে যাবে। মুখে যাকাত কথাটা বলার আবশ্যকতা নেই।
সূত্র: আহকামে যিন্দেগী।