যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে
সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে;
যে জাতি জীবনহারা অচল অসাড়
পদে পদে বাঁধে তারে জীর্ণ লোকাচার।
আজকে আমরা আলোচনা করবঃ
ভাব সম্প্রসারণঃ
মূলভাব: গতিশীলতা প্রাণের ধর্ম। যেখানে গতি নেই, চঞ্চলতা নেই, সেখানে স্থবিরতা জেঁকে বসে। ব্যক্তিগত, সামাজিক, জাতীয় – সকল ক্ষেত্রেই স্থবিরতা যাবতীয় অর্জন ধ্বংস করে দেয়। তাই কৃতিত্ব, সাফল্য ও সমৃদ্ধির জন্য গতিশীলতার কোনো বিকল্প নেই।
সম্প্রসারিত ভাব: নদীর ধর্ম বয়ে চলা। স্রোতই তার গৌরব। স্রোত না থাকলে নদী ধীরে ধীরে মরে যায়। স্রোতের টানে বিশাল জলরাশি পাহাড় থেকে সমুদ্রের দিকে ধেয়ে চলে। এই স্রোতই নদীকে প্রাণের স্পন্দনে জাগিয়ে রাখে, দুই পাড়ে জন্ম দেয় নতুন নতুন সভ্যতার। তার গতিচাঞ্চল্যে ফুটে ওঠে জীবনের বলিষ্ঠ প্রকাশ। সব জঞ্জাল ভাসিয়ে নিয়ে সব রকমের পঙ্কিলতা থেকে নদীকে মুক্ত রাখে স্রোত। তবে কখনো যদি এই স্রোত থেমে যায়, রুদ্ধ হয় কোনো গণ্ডির সীমায়, তবে নদী তার গৌরব হারায়। নদীর বুকে জন্ম নেয় অসংখ্য জলজ উদ্ভিদ, আবর্জনায় ঢেকে যায় টলমলে জলের ধারা। গতিচাঞ্চল্য, ছন্দময়তা আর জলকল্লোল হারিয়ে নদীটি নির্জীব হয়ে পড়ে। ব্যক্তি, সমাজ ও জাতি নদীর মতো গতিময়তায় তার প্রাণ; গতিহীনতায় তার মৃত্যু। আধুনিকতা, উন্নয়ন, অগ্রগতি, সমৃদ্ধি – প্রতিটি ধারণার সঙ্গে উদ্যম, গতিময়তা ও পরিবর্তনশীলতার যোগ রয়েছে। কোনো ব্যক্তি বা সমাজ যদি প্রাচীনতাকে আঁকড়ে ধরে নতুন সময়ে টিকে থাকতে চায়, তবে ওই ব্যক্তি বা সমাজ নতুন সময়ের দাবিকে উপেক্ষা করল। অযৌক্তিক বিশ্বাস, মিথ্যা ও সংকীর্ণ সংস্কার আর অচল ভাবনার নাগপাশ থেকে বেরিয়ে যে জাতি পরিবর্তনকে মেনে নিতে পারে না, তারা স্রোতহীন নদীর মতো স্থবির হয়ে পড়ে। তাতে যুক্ত হয় মিথ্যা সংস্কারের নতুন নতুন জঞ্জাল। রুদ্ধ হয় সম্ভাবনার সকল দ্বার। আর যে জাতি একটি স্বাভাবিক চলনধর্ম মেনে নতুনকে স্বাগত জানায়, নিঃসঙ্কোচে আলিঙ্গন করে নতুন সভ্যতাকে, সংস্কারের নাগপাশ ছিন্ন করে নতুন জ্ঞানকে গ্রহণ করে, সে জাতিকে কখনো স্থবিরতা পেয়ে বসে না।
মন্তব্য: পরিবর্তন আর অগ্রগতির প্রধান শর্ত গতিশীলতা। সবকিছু স্থবির থাকলে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতার এতখানি অগ্রসরতা ঘটতো না।
ভাব সম্প্রসারণ কীঃ
কবি-সাহিত্যিকদের লেখায় কখনো কোনো একটি বাক্যে বা কবিতার এক বা একাধিক চরণে গভীর কোনো ভাব নিহিত থাকে। সেই ভাবকে বিস্তারিতভাবে লেখা, বিশ্লেষণ করাকে ভাবসম্প্রসারণ বলে।
যে ভাবটি কবিতার চরণে বা বাক্যে প্রচ্ছন্নভাবে থাকে, তাকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করতে হয়। সাধারণত সমাজ বা মানবজীবনের মহৎ কোনো আদর্শ বা বৈশিষ্ট্য, নীতি-নৈতিকতা, প্রেরণামূলক কোনো বিষয় যে পাঠে বা বাক্যে বা চরণে থাকে, তার ভাবসম্প্রসারণ করা হয়। ভাবসম্প্রসারণের ক্ষেত্রে রূপকের আড়ালে বা প্রতীকের ভেতর দিয়ে যে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়, তাকে যুক্তি, উপমা, উদাহরণ ইত্যাদির সাহায্যে বিশ্লেষণ করতে হয়।
ভাব সম্প্রসারণের কয়টি অংশঃ
পরীক্ষায় বাংলা দ্বিতীয় পত্র বিষয়ের ভাব-সম্প্রসারণে বেশি নম্বর পেতে মূল ভাব ঠিক রেখে সঠিক বানানে উত্তর লিখবে ও বিখ্যাত ব্যক্তির উক্তি দেবে। ভাব-সম্প্রসারণ তিনটি প্যারায় লিখবে।
ভাব সম্প্রসারণ লেখার নিয়মঃ
কোনো কবিতা বা গদ্যরচনার অংশকে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করাকে ভাব-সম্প্রসারণ বলে। কবিতার বেলায় সেইসব পঙ্ক্তির ভাব-সম্প্রসারণ দরকার হয়, যেগুলোর মধ্যে সুনির্দিষ্ট কোনো বক্তব্য বা তত্ত্ব থাকে। অন্যদিকে গদ্যরচনার সেইসব বাক্য ভাব-সম্প্রসারণের জন্য ঠিক করা হয়, সাধারণত যা প্রবাদ বা প্রবচনের মর্যাদায় উন্নীত। ভাব-সম্প্রসারণ করার সময়ে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো মনে রাখা যেতে পারে:
ক. ভাব-সম্প্রসারণকে প্রধানত তিনটি অংশে বিভক্ত করা যায়: প্রথম অংশে ভাবের অর্থ, দ্বিতীয় অংশে ভাবের ব্যাখ্যা এবং তৃতীয় অংশে ভাবের তাৎপর্য।
খ. ভাব-সম্প্রসারণের এই অংশগুলোকে আলাদা তিনটি অনুচ্ছেদে উপস্থাপন করা যায়।
গ. ভাবের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যুক্তি দেখাতে হয়, উদাহরণ দিতে হয়, তুলনা করতে হয়।
ঘ. ভাব-সম্প্রসারণের বাক্যগুলো যাতে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার।
ঙ. প্রয়োজনে সংক্ষিপ্ত উদ্ধৃতি ব্যবহার করা যেতে পারে।
চ. ভাব-সম্প্রসারণে আলাদা কোনো শিরোনামের দরকার হয় না।
ছ. মূল ভাবটি রূপক বা প্রতীকের আড়ালে থাকলে তাকে স্পষ্ট করতে হয়।
জ. ভাব-সম্প্রসারণ করার সময়ে প্রদত্ত অংশের রচয়িতার নাম উল্লেখ করতে হয় না।
ঝ. কমবেশি ২০০ শব্দ অথবা অনধিক ২০টি বাক্যের মধ্যে ভাব-সম্প্রসারণ সীমিত থাকা উচিত।
উপরে- যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে; যে জাতি জীবনহারা অচল অসাড় পদে পদে বাঁধে তারে জীর্ণ লোকাচারঃ ভাব সম্প্রসারণের একটি নমুনা দেওয়া হয়েছে।
ভাব সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যঃ
ভাবের শিল্পসম্মত প্রসারণই ভাব-সম্প্রসারণ। নানা তথ্যে, ভাব তাৎপর্যে ও ইঙ্গিতের মধ্য দিয়ে লুক্কায়িত কোনাে বিষয় বিস্তৃতভাবে সহজবােধ্য করে প্রকাশ করাই ভাব-সম্প্রসারণের প্রধান উদ্দেশ্য।
সাধারণত কবিতার পঙক্তি, স্তবক কিংবা গদ্যের অংশবিশেষ, কোনাে মনীষীর উদ্ধতি কিংবা প্রবাদ-প্রবচন ভাব-সম্প্রসারণের জন্য। দেওয়া হয়। আর এ ক্ষুদ্র অংশের আড়ালে থাকতে পারে মানবজীবনের গভীর অভিব্যক্তি, মানবতার কথা, নৃশংসতার কথা, সামাজিক বৈষম্যের কথা, ব্যক্তির স্বার্থপরতার কথা, সংসার জীবনের নানা অসংগতির কথা, নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি, সমাজ-রাষ্ট্র অথবা বিশ্বশান্তির কোনাে বার্তা। ভাব-সম্প্রসারণের বক্তব্যকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তি-তর্ক, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, দৃষ্টান্তসহ বস্তুনিষ্ঠ এবং প্রাঞ্জল ভাষায় উপস্থাপন করাই মূল কাজ। কবি বা লেখক তাঁর সৃষ্টির প্রয়ােজনে সামান্য অংশে নানা উপমা, অলংকার ব্যবহার করতে পারেন; আকর্ষণীয় করার প্রয়ােজনে বক্তব্যকে নাটকীয়ভাবে উপস্থাপন করতে পারেন, সংলাপ থাকতে পারে, এমনকি প্রশ্নেরও অবতারণা হতে পারে, থাকতে পারে শব্দ ও বাক্য ব্যবহারে যথেষ্ট মুনশিয়ানা; এর ফলে সহজেই সেই বক্তব্যকে উদ্ধার করা সম্ভব নয়। তাই মূল বিষয়টিকে আবিষ্কার করে প্রয়ােজনীয় যুক্তির সাহায্যে ব্যাখ্যা, বিচার-বিশ্লেষণ, উদাহরণ কিংবা দৃষ্টান্তসহ নিজস্ব অভিমত সহজ-সরল ভাষায় উপস্থাপন করতে হয়।
ভাব সম্প্রসারণের প্রয়ােজনীয়তাঃ
- যে কোনাে সংক্ষিপ্ত, যুক্তিপূর্ণ বক্তব্যকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার যােগ্যতা অর্জিত হয়।
- ভাব-প্রকাশে ভাষা চর্চার আবশ্যকতা রয়েছে তা অনুধাবন করা যায়।
- সংক্ষিপ্ত বিষয় থেকে নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়।
- কোনাে বিশেষ বক্তব্য থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কৌশল রপ্ত করা যায়।
- অপেক্ষাকৃত কঠিন কথাকে সহজ করে বলার যােগ্যতা অর্জিত হয়।