আজকে আমরা আলোচনা করবঃ
রচনা লেখা নিয়ম-
প্ৰবন্ধ/রচনা কি? রচনা কত প্রকার ও কি কি?
প্ৰবন্ধ/রচনা/রচনা এক প্রকার গদ্য রচনা। রচনা শব্দের অর্থ নির্মাণ বা সৃষ্টি করা। কোনো বিশেষ ভাব বা তত্ত্বকে ভাষার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার নামই রচনা। কোনো বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দিতে প্ৰবন্ধ/রচনা/রচনা রচিত হয়।
সব ধরনের প্ৰবন্ধ/রচনাকে অন্তত তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়, যথা – বর্ণনামূলক প্ৰবন্ধ/রচনা, চিন্তামূলক প্ৰবন্ধ/রচনা ও ব্যক্তি অনুভূতিমূলক প্ৰবন্ধ/রচনা।
উদাহরণস্বরূপঃ বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প’ বা ‘ভাষা আন্দোলন’ প্ৰবন্ধ/রচনাকে বলা যায় বর্ণনামূলক প্ৰবন্ধ/রচনা, ‘সময়ানুবর্তিতা’ বা ‘মাদকাসক্তি’ প্ৰবন্ধ/রচনাকে বলা যায় চিন্তামূলক প্ৰবন্ধ/রচনা, এবং ‘লঞ্চ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা’ বা ‘কোনো ঘটনার স্মৃতি’ প্ৰবন্ধ/রচনাকে বলা যায় ব্যক্তি অনুভূতিমূলক প্ৰবন্ধ/রচনা।
রচনা লেখার ফরমেট/স্টাইলঃ
রচনার সাধারণত তিনটি অংশ। যথা-
১। ভূমিকা: প্রবন্ধের প্রথম অনুচ্ছেদটি হবে এর ভূমিকা বা সূচনা। ভূমিকা হচ্ছে প্রবন্ধের সূচনা অংশ। অনেকটা বিষয়ে ঢোকার দরজার মতো ভূমিকা যত বিষয় অনুযায়ী, আকর্ষণীয় ও মনোরম হয় ততই ভালো। লক্ষ রাখা দরকার, ভূমিকা অংশে যেন অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য ভিড় না করে আর তা যেন খুব দীর্ঘ না হয়।
ভূমিকা হল বাড়ীর দরজার মতো। তাই আপনি কি নিয়ে রচনা লিখতে চলেছেন তা পরিষ্কার করে ফুটিয়ে তুলবেন ভূমিকা তে।
এমনভাবে ভূমিকা লিখুন, যেন পাঠক বুঝতে পারেন আপনি কিসের ওপর রচনা লিখতে চলেছেন। কিন্তু সেই সব ব্যাপারে বেশী তথ্য ভূমিকা তে দেবেন না। কিন্তু পাঠকের মনে আরও ভেতরে প্রবেশ করার একটা কৌতূহল জন্মাবে, মানে পাঠক আপনার রচনা পড়তে আগ্রহী হবেন। পাঠক এর মনে হবে- এর পরে কি আছে, আরও একটু পড়া যাক।
২। মূল অংশ: ভূমিকার পরে প্রবন্ধের মূল বিষয়ের আলোচনা শুরু হয়। প্ৰবন্ধ/রচনাের মূল অংশ একাধিক অনুচ্ছেদে বিভক্ত হয়ে থাকে। অনুচ্ছেদগুলো যাতে সমরূপ থাকে সেদিকে লক্ষ রাখতে হয়। বিশেষভাবে বর্ণনামূলক ও চিন্তামূলক প্ৰবন্ধ/রচনাের বেলায় অনুচ্ছেদগুলোর আলাদা শিরোনাম থাকে। এগুলোর নাম অনুচ্ছেদ-শিরোনাম। এসব শিরোনামের পরে কোলন যতি (:) দিয়ে লেখা শুরু করা যায়।
৩। উপসংহার: প্রবন্ধের সর্বশেষ অংশ উপসংহার। সূচনার মতো সমাপ্তিরও আছে সমান গুরুত্ব। প্রবন্ধের ভাববস্তু ভূমিকার উৎস থেকে ক্রমাগ্রগতি ও ক্রমবিকাশের ধারা বহন করে উপসংহারে এসে একটি ভাবব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে সমাপ্তির ছেদ-রেখা টানে। এখানে লেখকের ব্যক্তিগত অভিমত প্রকাশের যথেষ্ট অবকাশ থাকে। উপসংহারে লেখক একদিকে যেমন আলোচনার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, অন্যদিকে তেমনি লেখকের নিজস্ব অভিমতের কিংবা আশা-আকাঙ্ক্ষার সার্থক প্রতিফলনও ঘটে।
তাই কখনোই তাড়াহুড়ো করে, যেমন তেমন করে উপসংহার লিখে রচনাটি শেষ করে দেবেন না যেন। উপসংহার হবে –আপনি এতক্ষণ যা কিছু লিখলেন তার সারকথা।
প্ৰবন্ধ/রচনা লেখার সাধারন নিয়মঃ
- ক. ভূমিকা হলো প্ৰবন্ধ/রচনাের প্রবেশক অংশ। এটি সাধারণত এক অনুচ্ছেদের হয়। এই অংশে প্রায়ই মূল আলোচনার ইঙ্গিত থাকে।
- খ. প্ৰবন্ধ/রচনাের মূল অংশ একাধিক অনুচ্ছেদে বিভক্ত হয়ে থাকে। অনুচ্ছেদগুলো যাতে সমরূপ থাকে সেদিকে লক্ষ রাখতে হয়। যুক্তি বা কালের অনুক্রম মনে রেখে অনুচ্ছেদগুলোর সমরূপতা ঠিক করা যেতে পারে।
- গ. বিশেষভাবে বর্ণনামূলক ও চিন্তামূলক প্ৰবন্ধ/রচনাের বেলায় অনুচ্ছেদগুলোর আলাদা শিরোনাম থাকে। এগুলোর নাম অনুচ্ছেদ-শিরোনাম। এসব শিরোনামের পরে কোলন যতি (:) দিয়ে লেখা শুরু করা যায়।
- ঘ. উপসংহার হলো প্ৰবন্ধ/রচনাের সমাপ্তি অংশ। প্ৰবন্ধ/রচনাের প্রকৃতি অনুযায়ী এখানে সাধারণত ফলাফল, সম্ভাবনা, সীমাবদ্ধতা, প্রাসঙ্গিকতা ইত্যাদি স্থান পায়।
- ঙ. প্ৰবন্ধ/রচনাের ভাষা হওয়া উচিত সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল।
- চ. প্ৰবন্ধ/রচনাের প্রতিটি অনুচ্ছেদ লেখার সময়ে প্ৰবন্ধ/রচনাের শিরোনামের কথা মনে রাখতে হয়, তাতে প্ৰবন্ধ/রচনাের মধ্যে অপ্রাসঙ্গিক আলোচনা প্রবেশ করতে পারে না।
- ছ. উদ্ধৃতি ব্যবহারে সতর্ক হওয়া উচিত। অপরিহার্য না হলে উদ্ধৃতি ব্যবহার করা ঠিক নয়। বিশেষভাবে বাংলা প্ৰবন্ধ/রচনাের মধ্যে অন্য কোনো ভাষার উদ্ধৃতি বর্জনীয়।
- জ. প্ৰবন্ধ/রচনাের নির্দিষ্ট কোনো আয়তন নেই। এমনকি এর অনুচ্ছেদসংখ্যাও নির্দিষ্ট করা যায় না। তবে নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য প্ৰবন্ধ/রচনাের শব্দসংখ্যা কমবেশি এক হাজার হতে পারে।
রচনার লেখার সাধারণ নিয়মের পাশাপাশি আরও যা যা লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন:
প্রবন্ধ রচনার সময় কিছু নিয়মকানুন অনুসরণ করা প্রয়োজন। তাহলে প্রবন্ধের মান বৃদ্ধি পায় এবং পরীক্ষায় অধিক নম্বর পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে-
১। রচনা লিখার পর একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিন সব বানান ঠিক আছে কিনা
২। সাধু ভাষা, চলিত ভাষা মিশিয়ে ফেলবেন না, যে কোন একটা ভাষা তে লিখুন।
৩। যে টপিকের ওপর রচনা লিখবেন, তার ওপর জ্ঞান থাকাটা খুবই জরুরী।
৪। আপনার জানা জ্ঞান কে খুব সুন্দর ভাবে পয়েন্ট অনুসারে সাজিয়ে লিখবেন। কোন তথ্য কোন হেডলাইনে রাখা যাবে তা আগে ঠিক করে নিন।
৫। কিছু বিখ্যাত কবিদের কবিতার লাইন যদি প্রাসঙ্গিক মনে হয়, তাহলে সেইসব লাইন বা কোন প্রাসঙ্গিক কোটেশন প্রতিটি হেডলাইনেই দিতে পারেন। তবে প্রাসঙ্গিকতা বিচার করে দেবেন।
৬। অপ্রাসঙ্গিক কিছুই লিখবেন না। তথ্য ছাড়া শুধু নানান রকম গল্প লিখে রচনা কে বিনা কারনে দীর্ঘায়িতো করবেন না।
রচনা প্রতিযোগিতায় রচনা লেখার নিয়মঃ
প্রবন্ধ রচনায় রাতারাতি কেউ দক্ষতা অর্জন করতে পারে না। এজন্যে নিয়মিত অনুশীলনের প্রয়োজন হয়।
এক্ষেত্রে নিচের নয়মগুলো অনুসরণ করা দরকার:
- নামকরা লেখকদের প্রব পড়া উচিত। লেখক কী বলেছেন, কীভাবে বলেছেন তা খুঁটিয়ে লক্ষ করা ভালো। পত্র পত্রিকায় কোনো বিষয়ে প্রবন্ধ চোখ পড়লে তা পড়া উচিত। এতে ধারণা বিকশিত হয় এবং শব্দভাণ্ডার বাড়ে।
- প্রবন্ধে কথার ফুলঝুরি কিংবা অপ্রয়োজনীয় বাড়তি কথা পরিহার করা উচিত। একই কথা যেন বার বার বলা না হয়।
- অল্প কথায় ভাব প্রকাশ করতে হবে। তাতে এই গুণ অর্জনের জন্যে সারাংশ ও সারমর্ম লেখার অভ্যাস।
- ভালো প্রবন্ধ লেখার জন্যে ভাষার ওপর সহজ দক্ষতা থাকতে হয়। সহজ, সরল ও ছোটো ছোটো বাক্যে প্রবন্ধ লেখার অভ্যাস করবে। তাতে দক্ষতা আসবে।
- মনে রাখবে, চিন্তামূলক প্রবন্ধের ভাষা হবে ভাবগম্ভীর আর লঘু প্রবন্ধের ভাষা হবে হালকা চালের।
- প্রবন্ধ রচনায় সবসময় প্রাসঙ্গিক বিষয়, চিন্তা ও তথ্যকেই গুরুত্ব দেবে। মূল বিষয় থেকে কখনো দূরে যাবে না।
- ভাষারীতির ক্ষেত্রে কখনো চলিত ও সাধু রীতি মিশিয়ে ফেলবে না।
- আধুনিক কালে চলিত রীতিই প্রাধান্য ও গুরুত্ব পাচ্ছে। তাই চলিত রীতিতে প্রবন্ধ লেখাই ভালো।
- প্রবন্ধের উৎকর্ষ নির্ভর করে নির্ভুল বানান ও বাক্যের শুদ্ধ প্রয়োগের ওপর। এ বিষয়ে সব সময় সজাগ ও সতর্ক থাকা দরকার।
- অনেক সময় চিন্তামূলক প্রবন্ধ সংহত কথাকে ব্যাখ্যা – বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিশদ করতে হয়।
- ভাবসম্প্রসারণ প্রক্রিয়া আয়ত্ত করলে তা এক্ষেত্রে কাজে লাগে।
- প্রবন্ধে প্রাসঙ্গিক ও সংক্ষিপ্ত উদ্ধৃতি এবং প্রবাদ প্রবচন ব্যবহার করা ভালো। অপ্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি কখনো ব্যবহার করা উচিত নয়।
- বেশি বেশি উদ্ধৃতি ব্যবহারও ভালো প্রবন্ধের লক্ষণ নয়।
- চিন্তামূলক রচনায় সংকেতসূত্র উল্লেখ করবে।
- বর্ণনামূলক রচনায় সংকেতসূত্র উল্লেখ করার দরকার নেই।
- যতটা সম্ভব নিজের ভাষায় সুন্দরভাবে গুছিয়ে নির্ভুলভাবে প্রবন্ধ লেখার অভ্যাস করতে হবে। এতেই দক্ষতা আসবে। কোনো ছক বাঁধা নিয়মে সার্থক রচনা লেখা যায় না।