আজকে আমরা আলোচনা করবঃ
লেয়ার মুরগি পালনঃ
লাভজনক লেয়ার মুরগি খামার স্থাপনের জন্য প্রয়োজন মূলধন, খামারের আয়তনসহ সুষ্ঠু পরিকল্পনা, লেয়ারের স্ট্রেন নির্বাচন ও বাচ্চা সংগ্রহ, সুলভে খাদ্য সরবরাহ, লাভজনক মূল্যে ডিম বাজারজাতকরণ, রোগ প্রতিরোধ ইত্যাদি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান।
লেয়ার মুরগি পালনের মোট তিনটি স্তর যথা- ১। বাচ্চা পালন, ২। বাড়ন্ত মুরগি পালন এবং ৩। লেয়ার অবস্থায় পালন ।
লেয়ার মুরগির জাত নির্বাচনঃ
- হোয়াইট লেগ হর্ণ জাতের মুরগি প্রচুর ডিম দেয় বলে বিশ্ব প্রসিদ্ধ। বর্তমানে অধিক ডিম উৎপাদনকারী বিভিন্ন জাতের মুরগি সংকরায়নের মাধ্যমে বিভিন্ন লেয়ার স্ট্রেন সৃষ্টি হয়েছে।
- এসব মুরগি উন্নত ব্যবস্থাপনায় বছরে প্রায় ২৮০টি ডিম পাড়ে এবং প্রতিটি ডিমের ওজন হয় ৬০-৬৫ গ্রাম।
বাংলাদেশে যেসব লেয়ার স্ট্রেন পাওয়া যায় তাদেরও প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা নিম্নে দেয়া হল ।
- হাইসেক্স (Hisex) হোয়াইট/ব্রাউন – এগ্স এন্ড হেন্স লিঃ জয়দেবপুর।
- স্টার ক্রস ব্রাউন (Starcross brown) – কাজলী হ্যাচারী লিঃ, গাজীপুর; বিমান পোল্ট্রি কমপ্লেক্স, সাভার।
- লোহমেন ব্রাউন (Lohmann) – কেন্দ্রীয় হাঁস-মুরগি খামার, মিরপুর, ঢাকা : ফিনিক্স পোল্ট্রি লিঃ, সাভার।
- ইসা ব্রাউন (ISA brown) – আফতাব বহুমুখী ফার্ম, কাকরাইল, ঢাকা; ঊষা পোল্ট্রি লি, সাভার। ইউনাইটেড ফুড কমপ্লেক্স লিঃ, সাভার; সিলভারকার্প লিঃ, ঢাকা; কাজী ফার্ম লিঃ, ঢাকা ।
- হাইলাইন ব্রাউন (Hy-line brown) – ঢাকা হ্যাচারী লিঃ, ঢাকা : কাজী ফার্মস লিঃ, ঢাকা।
- বিভি ৩০০ (BV 300) – কাজী ফার্মস লিঃ, ঢাকা ।
লেয়ার মুরগির পালন পদ্ধতি ও ব্যবস্থাঃ
লেয়ার মুরগি পালনের প্রধান তিনটি স্তর যথা- ১। লেয়ার বাচ্চা পালন, ২। বাড়ন্ত লেয়ার মুরগি পালন এবং ৩। ডিম পাড়া (লেয়ার অবস্থায়) মুরগি পালন।
১। লেয়ার বাচ্চা পালন।
‘মুরগির বাচ্চা পালন’ অর্টিকেল এ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। তাই এখানে আর বর্?ণনা করা হলো না।
সাধারণত ১ দিন থেকে ৮ সপ্তাহ (দুই মাস) বয়স পর্যন্ত লেয়ার বাচ্চা পালনের অন্তর্ভুক্ত।
২। বাড়ন্ত লেয়ার মুরগি পালন।
→ বাড়ন্ত বয়সে লেয়ার জাতের মুরগিকে পর্যাপ্ত সুষম খাদ্য সরবরাহ ও যত্নের সাথে লালন পালন করা প্রয়োজন। কারণ বাড়ন্ত বয়সে মুরগির স্বাস্থ্য সুগঠিত হলে সঠিক সময় পর্যাপ্ত সংখ্যক ডিম পাড়ে।
→ সাধারণত ২-৪ মাস বয়সের মুরগিকে লেয়ার বাড়ন্ত মুরগি বলা হয়।
→প্রতিটি লেয়ার বাড়ন্ত মুরগিকে প্রতিদিন ২০০-৩০০ গ্রাম খাদ্য সরবরাহ করতে হয়। খাদ্য সুষমভাবে তৈরি করার জন্য খাদ্যে পরিমিত ভিটামিন- মিনারেল প্রিমিক্স মিশিয়ে খাওয়াতে হবে।
→ লেয়ার বাড়ন্ত মুরগির সুষম খাদ্য তালিকা টেবিলে (১৬) দেয়া হয়েছে। এছাড়া ৮-১৬ সপ্তাহ বয়সের লেয়ার বাড়ন্ত মুরগির জন্য গম ভাঙ্গা ৪০ ভাগ, গমের ভূষি ১০ ভাগ, খেসারির ভূষি ১০ ভাগ, শুটকি মাছের গুড়া ১০ ভাগ, খৈল ১০ ভাগ, গবাদিপশুর নাড়িভুঁড়ি ১০ ভাগ, ঝিনুকের গুঁড়া ১.৫ ভাগ, লবণ ০.৫ ভাগ এবং শাক- সবজি ৭.০ ভাগ সমন্বয়ে (মোট ১০০ ভাগ) খাদ্য প্রস্তুত করে খাওয়ানো যায়।
সাধারণত ১৮ সপ্তাহ বয়স হলেই বাড়ন্ত লেয়ার মুরগিকে ডিম পাড়া ঘরে স্থানান্তরিত করতে হবে।
৩। ডিমপাড়া (লেয়ার অবস্থায়) মুরগি পালন ।
→ লেয়ার মুরগির খাদ্যে অবশ্যই ভিটামিন-মিনারেল প্রিমিক্স থাকা প্রয়োজন। প্রতিটি লেয়ার মুরগি দৈনিক ৩০০-৪০০ গ্রাম খাদ্য খেয়ে থাকে।
→ সাধারণত ২১-৭৫ সপ্তাহ পর্যন্ত ডিম পাড়া মুরগি লাভজনকভাবে ডিম দেয়। তাই সর্বোচ্চ সংখ্যায় ডিম উৎপাদনের জন্য সুষম খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, রোগমুক্ত ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশের ব্যবস্থা করা অত্যাবশ্যক।
→ উন্নত জাতের ডিম পাড়া মুরগি পালন প্রধানত দু’ভাবে করা হয়। যথা— লিটার পদ্ধতিতে পালন এবং খাঁচায় মুরগি পালন । উভয় পদ্ধতি সম্পর্কে ‘মোরগ-মুরগি পালন পদ্ধতি’ অংশে বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
→ লেয়ার মুরগির খাদ্য তালিকা টেবিলে (১৭) দেয়া হয়েছে। এছাড়াও গম ভাঙ্গা ৫০ ভাগ, গমের ভূষি ১০ ভাগ, খেসারি ভূষি ১০ ভাগ, শুটকি মাছের গুড়া ১০ ভাগ, খৈল ১০ ভাগ, ঝিনুকের গুড়া ৩.৫ ভাগ, লবণ ০.৫ ভাগ এবং শাক-সবজি ৬.০ ভাগ সমন্বয়ে (মোট ১০০ ভাগ) খাদ্য প্রস্তুত করে খাওয়ানো যায় ।

লেয়ার মুরগি পালনে করণীয়ঃ
→ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত পরিবেশ।
→ খাবার ও পানির পাত্র প্রত্যহ করে পানাহার সরবরাহ করতে হবে।
→ ঘর ও ঘরের সকল আসবাবপত্র সঠিক নিয়মে পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
→ মেঝের বিছানা বা লিটার ব্যবস্থাপনা।
→ উলেয়ার ঘরের লিটার সপ্তাহে দুই বার করে ওলটপালট করে দিতে হয়। এছাড়া মাঝে মধ্যে লিটারে চুন ছিটিয়ে দিতে হয়।
→ লেয়ার ঘরের মেঝেতে ১৫-২০ সেন্টিমিটার পুরু নতুন লিটার বিছিয়ে বিছানা তৈরি করতে হয়।
→ বাড়ন্ত লেয়ার মুরগি ডিম পাড়া আরম্ভ করলেই লেয়ার হাউসে রাখতে হয়।
খাদ্য ও আলোর ব্যবস্থাঃ
→ লেয়ার মুরগির ঘরে আলোর জন্য ৪০-৬০ ওয়াটের বাল্ব জ্বালিয়ে রাখা যায়।
→ পর্যাপ্ত সংখ্যক ডিম উৎপাদনের জন্য লেয়ার মুরগিকে সুষম খাদ্য সরবরাহ করা প্রয়োজন। এছাড়া এদের দেহে প্রচুর ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন হয়। তাই এসময় দেহে ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরণের জন্য ঝিনুকের গুড়া খাওয়াতে হয়।
→ লেয়ার ঘরে প্রত্যহ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গড়ে ১৬ ঘণ্টা আলোর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন যাতে দেহের চাহিদা অনুযায়ী পানাহার করতে পারে।
লেয়ার মুরগির জন্য সুষম খাদ্য তালিকাঃ
ক্র.নং. | খাদ্য উপাদান (%) | লেয়ার : স্টাটার (বাচ্চা (১-৩ সপ্তাহ) | লেয়ার : গ্রোয়ার (বাচ্চা) (১-৩ সপ্তাহ) | লেয়ার : (ডিম পাড়া) (১-৩ সপ্তাহ) |
১। | গম ভাঙ্গা | ৩৬.০ | ৩৪.০ | ৩৫.০ |
২। | গমের ভূষি | ১০.০ | ১০.০ | ১০.০ |
৩। | চাল ভাঙ্গা | ১০.০ | ১০.০ | ১০.০ |
৪। | চালের কুড়া | ০৮.০ | ১৫.০ | ১০.০ |
৫। | তিলের খৈল | ১২.০ | ১২.০ | ১২.০ |
৬। | শুটকি মাছের গুড়া | ১৪.০ | ১০.০ | ১২.০ |
৭। | হাড়ের গুড়া | – | – | – |
৮। | চিটা গুড় | ০২.০ | ০২.০ | ০২.০ |
৯। | ঝিনুকের গুড়া | ০২.০ | ০৩.০ | ০৮.০ |
১০। | খেসারী সিদ্ধ | ০৫.০ | ৩.০ | – |
১১। | লবণ | ০০.৫ | ০০.৫ | ০০.৫ |
১২। | প্রিমিক্স* | ০০.৫ | ০০.৫ | ০০.৫ |
মোট | ১০০ | ১০০ | ১০০ |
লেয়ার মুরগির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাঃ
→ সময়মত প্রয়োজনীয় কৃমির ঔষধ খাওয়ানো দরকার এবং সময়মত রোগ প্রতিষেধক টিকা দিতে হবে।
অন্যান্য ব্যবস্থাদিঃ
→ প্রত্যহ ২-৩ বার ডিম সংগ্রহ করতে হবে।
→ সাধারণত ৭২-৭৫ সপ্তাহ বয়সে ডিম পাড়া মুরগি লাভজনক ভাবে ডিম উৎপাদন করতে পারে না। তাই এই সময়ে মুরগি বিক্রি করে দেয়া উত্তম ব্যবস্থা।
খামার ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সমস্যাদিঃ
→ মুরগির খামার ব্যবস্থাপনা একটি বিজ্ঞান সম্মত কাজ। খামার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানের অভাবে অনেক সময় সামান্য ত্রুটির জন্য অনেক ক্ষতি হয়ে থাকে। সামান্য ত্রুটির কারণে ডিম পাড়া মুরগির ডিম উৎপাদন হ্রাস পায়। এমনকি সময়মত ব্যবস্থা না নিলে মুরগি মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
→ আমাদের দেশে অধিকাংশ ফার্মের টিনের চালার ঘরে মুরগি পালন করা হয়। অন্যদিকে এখানে গ্রীষ্মকালে (বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসে) অত্যধিক গরম পড়ে। বিদেশি উন্নত জাতের মুরগি এই গরম একদম সহ্য করতে পারে না।
অত্যধিক গরমে লেয়ার মুরগির প্রতিক্রিয়াঃ
- মুরগির শ্বাসকষ্ট উপসর্গ দেখা দেয় এবং শ্বাস-প্রশ্বাসে শব্দ হয়।
- গরমে মুরগির অধিক পিপাসা পায় ফলে অধিক পানি পান করে কিন্তু দানাদার খাদ্য খাওয়া কমে যায়।
- ডিম পাড়া মুরগির ডিম উৎপাদনের পরিমাণ কমে যায় এবং অনেক সময় হঠাৎ সুস্থ মুরগি মারা যেতে পারে।
অত্যধিক গরমে লেয়ার খামারে করণীয়ঃ
→ খামারের ঘরের চালা টিন দিয়ে তৈরি হলে টিনের চালের নিচে সিলিং এর ব্যবস্থা করা।
→ দুপুরের রোদে টিনের চালের উপর পানি ঢেলে ঘর ঠাণ্ডা রাখার ব্যবস্থা করা যায়।
→ মুরগিকে রুচিকর সুষম খাদ্য ও পরিষ্কার পানি সরবরাহ করা।
→ খামারে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা।
→ মুরগির ঘরের পর্যাপ্ত আলো বাতাসের চলাচলের জন্য ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা করা।