রোগ সৃষ্টিকারী বীজাণুঃ
(১) প্রাণীজাতের বীজাণু,
(২) উদ্ভিদ জাতের বীজাণু,
(৩) ভাইরাস যা না প্রাণী না উদ্ভিদ জাতের।
১. প্রাণীজাতের বীজাণু (Protozoa)
এসব বীজাণু এককোষী আদিম প্রাণী যাকে খালিচোখে দেখা যায় না। অথচ নানাবিধ রোগের কারণ এসব ‘প্রোটোজোয়া’ বা এককোষী প্রাণী।
২. উদ্ভিদ জাতের বীজাণু (Bacteria)
এসব এককোষী বীজাণু বা ব্যাক্টেরিয়া গাছপালার আদিরূপ। পরজীবি এসব ব্যাক্টেরিয়া যার দেহে আশ্রয় নেয় তারই ক্ষতি করে থাকে। গোল চেহারার ব্যাক্টেরিয়াকে বলা হয় কক্কাস (Coccus) এবং লম্বা কাঠির মতো চেহারার ব্যাক্টেরিয়াকে বলা হয় ব্যায়সিলাস্ (Bacillus)।
৩. ভাইরাস (Viras)
এগুলো না উদ্ভিদ না প্রাণী এবং এতো ছোট যে ‘প্রোটোজোয়া’ ও ব্যাক্টেরিয়া সাধারণ অনুবীক্ষণ যত্নে দেখা যায়, কিন্তু ভাইরাস দেখা যায় না। ভাইরাসের প্রতিরোধের ভেকসিন বের হলেও এদের মারার ঔষধ আজও আবিষ্কৃত হয়নি। ভাইরাস দ্বারা গো বসন্ত, বিড়ারপেস্ট, রানীক্ষেত, ফাউল বসন্ত, ডাক প্লেগ, হেপাটাইটিস ইত্যাদি রোগের সৃষ্টি হয়।
৪. রোগ সৃষ্টিকারী কৃমি ও পোকা
ক. কৃমি (Worm)
এসব রোগ সৃষ্টিকারী কৃমি ও পোকা চোখে দেখা যায়। প্রোটোজোয়া ও ব্যাক্টেরিয়ার মতো মারাত্মক না হলেও ক্ষতিকারক। পশু-পাখীর পাকস্থলী ও অন্ত্রে যেসব কৃমি বাস করে এবং চাউলের সমান থেকে ৮০-৯০ সেন্টিমিটারও লম্বা হতে পারে। এরা রক্ত চোষে খায় ও ক্ষতের সৃষ্টি করে।
খ. উকুন (Louce)
কৃমির মতো এসব পোকা বা উকুনও পশু পাখীর মারাত্মক ক্ষতি করে। উকুন, টিটপোকা পশু-পাখীর গায়ে বসে রক্ত চোখে খায় ও ক্ষতের সৃষ্টি করে। আর সেই ক্ষতে মাছি ডিম পারে তাকে বিপজ্জনক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে।
পশুর রোগের লক্ষণ পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষাঃ
পশু তার সমস্যার কথা জানাতে পারে না। আবার তার পালনকারীরাও অনেক সময় সঠিকভাবে সমস্যা বলতে পারে না। তাই পশুকে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা করেই রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে হয়। রোগ নির্ণয়ের জন্যে পশুর নানাবিধ বিষয়াদি পর্যবেক্ষণ পরীক্ষা করতে হয়। যেমন-
১. দেহ ও আচরণ পর্যবেক্ষণ
—দীর্ঘদিন উদরাময় ও কৃষি আক্রমণে ভুগলে পশুর অবস্থা জীর্নশীর্ন দেখাবে।
—জলাতঙ্কে অসুস্থ পশু আক্রমণাত্মক আচরণ করে।
—নিউমোনিয়া হলে পশু সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে হাঁপাতে থাকে।
—প্রসবের পর দুধ জ্বর হলে বাঁ পাশ চেপে ডানদিকে মাথা বাঁকিয়ে শুয়ে ঝিমাবে।
—পেটের যন্ত্রণায় পশু পিঠ কুঁজো করে দাঁড়িয়ে থাকে।
—পায়ে আঘাত, পক্ষাঘাত, ক্ষুর পচা, ফুট এণ্ড মাউথ ইত্যাদি রোগে পশু খুঁড়িয়ে চলে।
—মুখে ঘা, ফুট এণ্ড মাউথ, রিন্ডারপেস্ট ইত্যাদি রোগে পশুর মুখে লালা ঝরে এবং জলাতঙ্ক রোগে কুকুরের লালা ঝরে ও তাকে পাগলের মতো দেখায়।
২. গায়ের তাপ পর্যবেক্ষণ
—অধিকাংশ সংক্রামক রোগেই খুব জ্বর হয় এবং গরু-মহিষের কান গরম হয়ে ওঠে।
—পশুর দেহের তাপও ডাক্তারী থার্মোমিটারে মাপা যায়।
—থার্মোমিটারে েগায়ে তৈল বা ভেসেলিন মাখিয়ে পশুর মলদ্বারে ঢুকিয়ে একটু হেলিয়ে ধরতে হবে।
—হেলিয়ে ধরায় মলনালীর ভেতরের গায়ে থার্মোমিটার লাগবে, এ অবস্থায় কমপক্ষে ২ মিনিট রেখে রিডিং দেখতে হবে।
৩. নাড়ী (Pulse) পর্যবেক্ষণ
—হৃদপিণ্ড সর্বদা রক্তকে পাম্প করে রক্তের নলে পাঠায় যা রক্তের নলে (Artery) ধাক্কা দেয়। ইহাই নাড়ী (Pulse)।
—যে কোন রক্তের নলের উপর হাত রাখলে তা টের পাওয়া যায়।
—মুখের নিচের চোয়ালের নিচ বরাবর ঘোড়ার, গরু-মহিষের লেজ তুলে মলদ্বার থেকে ১০ সেন্টিমিটার নিচে ককসিজিয়াল নলে (Coccigial Artcry) এবং উরুর উপরের ভেতর দিকে ছাগল-ভেড়ার নাড়ী পর্যবেক্ষণ করা যায়।
৪. মুখ ও পেট পরীক্ষা
—পশুর মুখ দিয়ে লালা ঝরলেও রোগের লক্ষণ দেখায় না প্রদাহ (Stonatitis) হলে।
—মুখের ঘায়ের সাথে বিষাক্ততা দেখা যায় রিণ্ডারপেস্টে।
—মুখে ও পায়ের ক্ষুরে একসাথে ঘা হয় ফুট এণ্ড মাউথ হলে।
—পশুর পেটে হাত রেখে টিপার সময় পেটে ব্যথা থাকলে পশুটি গোঙাবে।
—পাকস্থলীতে ৪টি অংশ থাকে গরু-মহিষ ও ছাগল-ভেড়ার।
—বাঁ দিকের উপরের অংশে টোকা দিলে ঢ্যাব ঢ্যাব করলে পেটে গ্যাসের লক্ষণ।
৫. মুত্রযন্ত্রের পরীক্ষা
—মুত্রযন্ত্রের বেদনা হলে প্রস্রাব কমে যায় ও শোথ হয়।
—মুত্র পরীক্ষা করলে রোগ ধরা পড়বে।
—কিডনিতে পাথর হলে অসহ্য যন্ত্রনা হবে।
৬. শ্বাসযন্ত্রের পরীক্ষা
—শ্বাসপ্রশ্বাস গোনার জন্যে অসুস্থ পশুর এমনভাবে দাঁড়াতে হবে যাতে সে দেখতে না পায়।
—পেট ও বুকের প্রতি মিনিটের ওঠানামার সংখ্যাই শ্বাস প্রশ্বাসের হার।
—৩ মিনিটে কতবার বুক ও পেঠ ওঠানামা করে তাকে ৩ দিয়ে ভাগ করলে শ্বাস প্রশ্বাসের হার পাওয়া যাবে।
—নাকের সামনে হাতের তালু ধরেও তা মাপা যায়।
৭. নাক ডাকার শব্দ (Snoring)
—নাক বা গলায় শ্বাস পথে সমস্যা হলে তা হয়।
—নেজাল গ্র্যানিউলোমা রোগে এমনটি হয়ে থাকে।
৮. কাশি
—ফুসফুসের রোগে কাশি দেখা যায়।
—গলায় প্রদাহ ও বুকে সর্দিতে শুকনো চাপা কাশি হয়।
৯. স্টেথস্কোপ দিয়ে বুক পরীক্ষা
—বুকের দুদিকে সামনের অংশে ফুসফুসের উপর যন্ত্রটি ধরলে শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যায়।
—ঘরঘর শব্দ ব্রংকাইটিসে, কিরকির শব্দ নিউমোনিয়া, ককর্ শব্দ পিউরিসিতে হয়ে থাকে।
১০. হৃদপিণ্ড (Heart) পরীক্ষা
—পশুর সামনের পা যেখানে কাঁধের সাথে যুক্ত হয় সেখানেই স্টেথোস্কোপ বসিয়ে শব্দ শোনা যাবে।
—প্রতি মিনিটে কতবার শব্দ হয় তা গুনতে হবে।
—নাড়ীর (Pulse) অবস্থা ও হার হার্টের অবস্থা জানা যাবে।
—হার্টের পাম্পিং দুর্বল হলে নাড়ীও দুর্বল হবে।
১১. মস্তিষ্ক ও নার্ভের পরীক্ষা
—ধনুস্টংকার ও জলাতঙ্কে পশুর খেচুনি হয়।
—পক্ষাঘাতে অঙ্গ প্রত্যক্ষ চালনার ক্ষমতা থাকে না।
—দুধ জ্বরে পেশী দুর্বল হয়ে পড়ে, তাকে পক্ষাঘাত বলা যাবে না।
১২. গায়ের চামড়া পরীক্ষা
—জ্বর হলে কানের চামড়া গরম হয়ে যাবে।
—দাদ, পাচড়া (mange), একজিমা, হলে দেখা যাবে।
—শোথ হলে গলকম্বল ফুলে, গলার চামড়া ফুলে হেসোরেঞ্জিক সেপটিসিসিয়া রোগে।
—এ্যান্থ্রাক্স রোগে দেহের নানা জায়গা ফুলে ওঠে।
—পশুর গায়ে পোকা বা উকুন হলে দেখা যাবে।
১৩. চোখ পরীক্ষা
—কজাঙ্কাটিভাইটিস্ হলে চোখ লাল হয়।
—ন্যারা হলে, লিভারে ফ্লক হলে কিম্বা ব্যাবেসিয়া হলে চোখ হলদে হয়ে যায়।
—কেরাকাইটিসের ফলে অসুস্থ হয়ে যায়।
১৪. মলমূত্র পরীক্ষা
—মুত্রে হিমোগ্লোবিন থাকে ব্যাবেসিয়া রোগে।
—মুত্রে রক্ত পাওয়া যায় পাথরের জন্যে নলের ভেতর কাটলে।
—মুত্রে পুঁজ থাকে মুত্র থলে প্রদাহ বা সিস্টাইটিস হলে।
—মলে রক্ত থাকে ককসিডিওসিস্, আমাশয়, রিন্ডারপেস্ট রোগে।
—শাদা মল হয় ন্যারা রোগে ও কৃমির ডিম পাওয়া যায় কৃমি হলে।
১৫. গাভীর জরায়ু পরীক্ষা
—গরু-মহিষের জরায়ু পরীক্ষায় হাতে লিকুইড প্যারাফিন মেখে নিবে।
—আঙ্গুলগুলো ছুচালো করে মলদ্বারে ঢুকাতে হবে।
—প্রথমে হাতে লাগবে পিছনের শক্ত ঢিবির মতো জরায়ুর গলা বা সার্ভিক্স, একটু আগে জরায়ুর হর্ণ যাতে বাচ্চা থাকে।
—বাচ্চা বড় হলে বাচ্চা হর্ণ ও জরায়ুর দেহ জুড়ে যায়।
কিছু কমন খাওয়ার ঔষধ ও ইনজেকশনের ঔষধের নাম-পরিচয়ঃ
বীজাণুনাশক ঔষধঃ
গত ৫০-৬০ বছরের মধ্যে বীজাণুনাশক নানান জাতের ঔষধ আবিষ্কৃত হয়েছে। এদের কতকগুলো রাসায়নিক ঔষধ আবার কতকগুলো ছত্রাক থেকে তৈরী। ছত্রাক জাত ঔষধ রোগের বীজ নষ্ট করতে সফল তাই এদের বলা হয় এন্টিবায়োটিক। রাসায়নিক ঔষধ ও ছত্রাক থেকে তৈরী এন্টিবোয়োটিক দিয়ে চিকিৎসাকে বলা হয় কেমো-থেরাপি।
সালফা জাতের ঔষধঃ
ঔষধের নামের আগে সালফা থাকে এবং এগুলো অধিকাংশ রোগের বীজাণু নস্ট করতে পারে ৷ নিউমোনিয়া, হেমোরেজিক, সেপাটিসিসিয়া, বীজাণুজনিত উদরাময়, ককসিউউসিয়া ইত্যাদি রোগে কার্যকর।
খাওয়ার ঔষধঃ
১. সালফাডিমিউন
প্রতিটি ৫ গ্রাম ওজনের ট্যাবলেট প্রতি কেজি দেহের ওজনে ৫০ মিঃ গ্রাম হারে খাওয়াতে হবে।
সালফামেজাথিন ১৬% সলিউশন ১০ মিলিলিটার ৪ লিটার জলে গুলে খাওয়ালে রোগ নিবারণ হয়। তবে চিকিৎসার জন্যে প্রতি ১ লিটার পানিতে ১০ মিলিলিটার ঔষধ গুলে খাওয়াতে হবে।
২. সালফা ডি-মেথসিন
ঔষধটি সালফামিডিনের চেয়ে শক্তিশালী। দেহে এর কর্মক্ষমতা থাকে ২৪ ঘণ্টা। তাই দৈনিক একবার খেলেই চলে।
৩. কো-ট্রিমক্সাজোল
ঔষধটি বীজাণুজনিত রোগের চিকিৎসায় অত্যন্ত কার্যকর। প্রতি ১৫ কেজি দেহের ওজনের জন্যে ১টি ট্যাবলেট খাওয়াতে হবে।
ইনজেকশনের ঔষধঃ
সালফাডিমিডিন ৩৩% সলিউশন। গরু-মহিষের চামড়ার নিচে বড় পশুর প্রতি ১০ কেজি ওজনের জন্যে ৩ মিলিলিটার এবং ছোট পশুর জন্যে প্রতি ৫ কেজি দেহের ওজনে ৩ মিলিলিটার ইনজেকশন দেওয়া যায়।
১. পেনিসিলিন
প্রথমে আবিষ্কারের পর প্রায় সকল বীজাণুর ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে স্ট্রেপ্টোকক্কাসে বেশি ব্যবহৃত হয়। তবে ম্যাস্টাইটিসে নিউমোনিয়া রোগেও ব্যবহার হতে দেখা যায়।
২. বেনজিল পেনিসিলিন
এটি একমাত্র শিরায় দেবার মতো পেনিসিলিন ইনজেকশন যার কর্মক্ষমতা ১২ ঘণ্টা থাকে। তাই দিনে দুটি ইনজেকশন দেয়া যায়। ৫ লাখ ইউনিট পাউডার ২ মিলিলিটার পরিশ্রুত জলে গুলে নিতে হয়।
৩. ফর্টিফায়েড পেনিসিলিন
পেশিতে দেয়ার ইনজেকশন। বড় পশুর জন্যে প্রতি কেজি ওজনের জন্যে ৫০০ ইউনিট। ছোট কুকুরে প্রতি কেজির জন্যে ২০,০০০ ইউনিট মাত্রা।
৪. স্ট্রেপটোমাইসিন
ক্ষয়রোগ, ব্রুসেলোসিস্, লেপটোম্পাইরোসিস্ ইত্যাদি রোগে কার্যকর। মাত্রা নিচের সারণী-১৭তে দেয়া হলো।
৫. ক্লোরেমফেনিকল
ঔষধটি ব্রংকাইটিস্ নিউমোনিয়া, বীজাণুজনিত উদরাময় ইত্যাদিতে কার্যকর।