বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জাতের ছাগল পাওয়া যায়। বৈচিত্রে, আকৃতিতে ও আচরণে তাদের বিভিন্নতা লক্ষণযোগ্য। প্রজননের মাধ্যমে চাহিদা অনুপাত এবং প্রয়োজনানুসারে শঙ্কর জাতীয় ছাগল তৈরি করা যায়। নিম্নে বিভিন্ন জাতের ছাগলের বিবরণ দেওয়া হলো :
১. বিটল্
পশ্চিম ভারতে এবং পাকিস্তানে বিটল্ জাতীয় ছাগল পাওয়া যায়। এরা কালো, সাদা, বাদামি বা যে-কোনো একাধিক রঙের সংমিশ্রণ যুক্ত হতে পারে। নাক ও মুখের গড়ন যমুনা পাড়ির মতো ঝুলন্ত নয়। এদের শিং পেছনের দিকে বাঁকা। ছাগীর দাড়ি নেই কিন্তু পাঠা বা পুরুষ ছাগলের দাড়ি আছে। যমুনা পাড়ির মতো আকারে বড় হয়। দৈনিক দুধের পরিমাণ ৩-৪ লিটার।
২. অ্যাংগোরা
নাইজেরিয়ায় অ্যাংগোরা ছাগলের উৎপত্তিস্থল। এ জাতীয় ছাগলের দেহ লম্বা ও সাদা লোমে আবৃত। এ লোমকে বলা হয় ‘মোহের বা মরক্কো ফাইবার’। লোম উৎপাদন ছাড়াও এ ছাগলের মাংস মোটামুটি সুস্বাদু। এ জন্য এ ছাগল মাংস উৎপাদনেও ব্যবহার করা হয়। দুধ উৎপাদন কম। গড়পড়তা শরীরের ওজন ৪০-৫০ কেজি। এরা গরম আবহাওয়া সহ্য করতে পারে না।
৩. সোনালি গোয়েন্সি
উৎপত্তিস্থল গোয়েন্সির নামানুসারে এ ছাগলের নামকরণ করা হয়েছে। ব্রিটিশ গোট সোসাইটি ১৭৯০ সালে একটি স্বতন্ত্রখাত হিসেবে এ ছাগলকে তালিকাভুক্ত করে। ১৯৭৪ সালে ব্রিটিশ সানেন্ পাঠা সোনালি গোয়েন্সি পাঠীর সাথে প্রজনন করে এ শঙ্কর জাতের ছাগল উৎপাদন করেন। এ শঙ্কর ছাগলের কান সোজা, শরীরের লোম ছোট ছোট ও সোনালি রঙের। গোয়েন্সি ছাগলের লোম বড় ও কোঁকড়ানো। এদের মাংস সুস্বাদু এবং দুধের উৎপাদন সন্তোষজনক।
৪. সানেন্ ছাগল
সানেন্ জাতের ছাগলের উৎপত্তিস্থল সুইজারল্যান্ড। হল্যান্ডের সমতল ভূমিতে এ জাতের ছাগল প্রচুর পাওয়া যায়। পৃথিবীর যে-কোনো দেশের স্থানীয় আবহাওয়ার সাথে তারা নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে। এদের অনেকের শিং আছে আবার কোনোটার শিং নেই। শরীর উজ্জ্বল সাদা ছোট ছোট লোমে আবৃত। যে ছাগলের চামড়া সাদা ও শরীর সাদা লোমে আবৃত তাদের শরীরে এক ধরনের ক্যান্সার দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু যে ছাগলের চামড়া কালো এবং লোম সাদা তাদের শরীরে সাধারণত এ জাতীয় রোগ হয় না। এদের শরীরের তুলনায় পা ছোট এবং ওলান বড় ও সুগঠিত। দৈনিক ৩ থেকে ৫ লিটার পর্যন্ত দুধ দেয় বলে দুগ্ধ খামারের জন্যে অত্যন্ত উপযোগী। দুধের মধ্যে ‘বাটার ফ্যাট’ শতকরা ৪ ভাগ।
৫. টোগেনবার্গ
সুইজারল্যান্ড ও আমেরিকায় এ জাতের ছাগল পাওয়া যায়। শরীরের রঙ হালকা বাদামি, কান খাড়া এবং শিং আছে। শরীরের লোম ছোট এবং খাড়া আবার কোনো কোনো ছাগলের লম্বা ও প্যাঁচানো লোম দেখা যায়। এ জাতের ছাগল গরম আবহাওয়া সহ্য করতে পারে। এরা আকারে বেশ বড় হয়। একটা পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ ছাগলের ওজন ৪৫ হতে ৫০ কেজি পর্যন্ত হয়। ছাগীর ওজন ২৭ হতে ৪০ কেজি পর্যন্ত হয়।
৬. ব্রিটিশ টোগেবার্গ
মিশ্র শঙ্কর জাতের ছাগল ব্রিটিশ টোগেবার্গ। এদের শরীরের রং টোগেবার্গের মতো বাদামি কিন্তু পেট, পিঠ ও কানে সাদা রঙ আছে। এ ছাগলের পা লম্বা এবং শরীর আকারে বড়। পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ ছাগলের ওজন ৬০ হতে ৬৫ কে. জি. এবং ছাগী প্রায় ৫০ হতে ৭০ কেজি। তারা মাঠে চরে খেতে পছন্দ করে এবং পার্বত্য ও শুষ্ক স্থানের জন্যে উপযুক্ত ৷ ‘স্টল ফিডিং’-এ অভ্যস্ত নয় বলে খামারের জন্যে তেমন উপযুক্ত নয়।
৭. এল্পাইন্
আদিম কালে ইউরোপের আলপ্স পর্বতমালার পাদদেশে পাওয়া যেত এল্পাইন্ ছাগল। এরা গরম আবহাওয়া এবং সমতল ভূমি অঞ্চলে থাকতে পারে এবং যে-কোনো অবস্থার জন্য উপযোগী। এদের শরীরের রঙ কালো কিন্তু সাদা ডোরা কাটা দাগ অথবা সাদা, কালো, বাদামি ইত্যাদি মিশ্র রঙেরও হতে পারে। বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ জাতের ছাগল খামারে প্রতিপালিত হচ্ছে। এদের শিং আছে এবং আকারে অত্যন্ত বড় হয়। দৈনিক ৪ হতে ৫ লিটার পর্যন্ত দুধ দেয়।
৮. অ্যাংলো নোবিয়ান
এ্যাংলো নোবিয়ান ভারতের যমুনা পাড়ি ও মিশরের জেরিবাই জাতের ছাগল হতে উৎপন্ন শঙ্কর জাতের ছাগল। ব্রিটেনের উদ্ভাবিত নোবিয়ান্ ছাগল অত্যন্ত উন্নতমানের। চেহারা এবং দুগ্ধ উৎপাদনে ছাগলের জুড়ি নেই। বছরে একটি করে বাচ্চা হয়। দৈনিক দুধের পরিমাণ ৫ হতে ৬ লিটার। দুধে ‘বাটার ফ্যাট’ শতকরা ৪ হতে ৫ ভাগ। এ ‘বাটার ফ্যাট’ থাকার দরুন নোবিয়ান্ ছাগলকে জার্সি গাভীর সাথে তুলনা করা হয়। দুগ্ধ উৎপাদন অবস্থায় গাভীন না হলে একটানা দু বছর যাবৎ দুধ দিতে পারে। এদের শরীরের রং সাদা, কালো, লাল, বাদামি বা মিশ্র হতে পারে। রোম খুব ছোট সুবিন্যস্ত এবং সুন্দর। শিং আছে, কান দুটো যমুনাপাড়ীর মতো ঝুলন্ত। এরা চরে খেতে ভালোবাসে কিন্তু আবদ্ধ অবস্থায় ‘স্টল ফিডিং’- এর জন্যেও উপযোগী।
৯. বারবারি
এদের উৎপত্তিস্থল মধ্য এবং পশ্চিম আফ্রিকা। ভারতের এটোয়া আগ্রা এবং মথুরা জেলাতে এ ছাগল পাওয়া যায়। বাংলাদেশে উত্তরাঞ্চলে এ ছাগল দেখা যায়। গাভীর মতো বারবারী ছাগল গোয়াল ঘরে বা স্টলে পালতে সহজ। এদের আকার মাঝারি। পুরুষ ছাগল পূর্ণ বয়সে ৪০-৫০ কেজি এবং স্ত্রী ছাগল ৩০-৩৫ কেজি পর্যন্ত ওজন হয়। শরীরের রঙ সাদা বা হরিণের মতো বাদামি সাদা ও কালো রঙের চক্রাকার হতে পারে। পা ছোট ওলান বড় ও নিচের দিকে ঝুলন্ত। দৈনিক দুধের উৎপাদন ২ হতে ৩ লিটার। দুধে চর্বি জাতীয় পদার্থের পরিমাণ শতকরা ৪ ভাগ। বছরে দু বার ১ হতে ২টা করে বাচ্চা দেয়।
১০. ছাগল তিব্বতী
তিব্বতের পাহাড়ি অঞ্চলে এ ছাগল পাওয়া যায়। এ ছাগলের বৈশিষ্ট্য এই যে, এদের শরীরে ৪ ইঞ্চি হতে ৫ ইঞ্চি লম্বা সিল্কের মতো সুন্দর লোমে আবৃত থাকে। এর লোম থেকে বিখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী কাশ্মীরের পশমি শাল, সোয়েটার, কম্বল, কার্ডিগান, কার্পেট ইত্যাদি তৈরি হয়। এ ছাগলের দুধ উৎপাদন খুব কম এবং মাংসও তেমন সুস্বাদু নয়। এরা গরম আবহাওয়া সহ্য করতে পারে না।
১১. বাংলাদেশি কালো ছাগল
‘কালো ছাগল’ বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের সমগ্র পশ্চিম বাংলা আসাম ও মেঘালয়ে পাওয়া যায়। এদের নাম ‘কালো ছাগল’ হলেও সাদা, বাদামি অথবা কালো রঙের সাথে সংমিশ্রণ অবস্থায় দেখা যায়। এ জাতের ছাগলের মাংস অত্যন্ত সুস্বাদু। মাংসের জন্যে এদের কদর সর্বত্র। বছরে দু বার এবং একত্রে দুটো হতে সর্বাধিক ৬টা পর্যন্ত বাচ্চা প্রসব করার নমুনা আছে। এরা দ্রুত বংশবিস্তার ঘটাতে পারে।
আফ্রিকার বেটে বা ছোট জাতের ছাগলের মতো এরা অত্যধিক কষ্টসহিষ্ণু ও চঞ্চল। অত্যন্ত নিম্নমানের ঘাসপাতা, লতাগুল্ম, কাটাঝোপ, গাছের ছাল-শিকড় ইত্যাদি খেয়ে জীবন ধারণ করতে সক্ষম। সুষম খাদ্য দিলে এবং ব্যবস্থাপনা উন্নত হলে দৈনিক দেড় লিটার পর্যন্ত দুধ দিতে পারে। তবে একসাথে অধিক বাচ্চা জন্মগ্রহণ করার ফলে অনেক সময় দুধে টান পড়ে। ফলে বাচ্চা অপুষ্টিজনিত রোগে ভোগে এবং পরে মারা যায়।
এদের সোজা কান ও খাড়া বা বাঁকা শিং থাকে। এরা আকারে খুব ছোট। পূর্ণ বয়স্ক একটি পাঠার ওজন ২৫ থেকে ৩০ কেজি। পাঠীর ওজন ১৫ থেকে ২০ কেজি। কম প্রবিষ্ট থাকার ফলে উন্নতমানের পাকা চামড়া উৎপন্ন হয়। যে সমস্ত ছাগলের লোম বড় কোঁকড়ানো ও রুক্ষ তাদের চামড়ার গভীরে লোম প্রবিষ্ট থাকে। ফলে চামড়া পাকা করার পরে স্পনজী বা শোষক অবস্থা প্রাপ্ত হয়।
১২. উন্নত জাতের শঙ্কর (ক্রস) ছাগল
ছাগলের জাত সংরক্ষণ অথবা শঙ্কর জাত উৎপাদন করতে হলে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। উন্নত জাতের বা বিদেশি পাঠার সাথে মিলনের ফলে উৎপাদিত শঙ্কর ছাগল হলেই যে ছাগলের মান উন্নত হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। শঙ্কর ছাগল তৈরির পূর্বে একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে নিতে হবে। মাংস উৎপাদন ইত্যাদি প্রয়োজন বা উদ্দেশ্য সামনে রেখে প্রজননের জন্যে পাঠা নির্বাচন করতে হয়। অপরদিকে উৎপাদিত বাচ্চার মধ্যে কিছু সংখ্যক থাকে যারা নিম্নমানের। বাচ্চার শারীরিক চেহারা, আকার, লোমের প্রকৃতি, শারীরিক বৃদ্ধি সর্বোপরি দুধ উৎপাদন ও বাচ্চা উৎপাদনের সংখ্যা এবং হার ইত্যাদি পর্যালোচনা করে পুনঃপ্রজননের জন্যে ছাগী বাছাই করা হয়।