ইলম কাকে বলে?
ইলম-এর শাব্দিক অর্থ জ্ঞান।
ইসলামের পরিভাষা অনুসারে কুরআন হাদীস তথা ইসলামের জ্ঞানকেই ইলম বলা হয়। ইল্মের সাথে সাথে আমলও কাম্য।
আমল বিহীন ই্লম ইলম হিসেবে আখ্যায়িত হওয়ার যোগ্য নয়।
ইলম হাছিল করার গুরুত্বঃ
আবশ্যক পরিমাণ ইলম হাছিল করা প্রত্যেক মুসলমান নর নারীর উপর ফরযে আইন। আর ফরয তরক করা কবীরা গোনাহ।
আবশ্যক পরিমাণ (যা প্রত্যেকের উপর ফরযে আইন) বলতে বুঝায় নামায, রোযা ইত্যাদি ফরয বিষয় এবং দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় লেন-দেন ও কায়-কারবার সম্পর্কিত বিষয়াদির মাসআলা-মাসায়েল ও হুকুম-আহকাম জানা।
আবশ্যক পরিমাণ অপেক্ষা অতিরিক্ত ইলম যা অন্যেরও উপকারার্থে প্রয়োজন, তা হাছিল করা ফরযে কেফায়া অর্থাৎ, কতক লোক অবশ্যই এরূপ থাকতে হবে যারা দ্বীনের সব বিষয়ে সমাধান বলে দিতে পারবেন, নতুবা সকলেই ফরয তরকের পাপে পাপী হবে।
তাই এলাকায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিজ্ঞ আলেম থাকা আবশ্যক।
ইলমের ফযীলতঃ
কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছেঃ তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে (কুরআন-হাদীসের) জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তা’আলা তাদের মর্যাদা অনেক উঁচু করে দেন। (সূরা মুজাদালাঃ ১১)
আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে দ্বীনী বুঝ (ধর্মীয় জ্ঞান) দান করেন। (বোখারী ও মুসলিম)
হযরত আবূ গিফারী (রাঃ) বলেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ হে আবূ যর! তুমি যদি সকাল বেলায় গিয়ে কুরআনের একটি আয়াত শিক্ষা কর, তাহলোে তোমার জন্য তা একশত রাকআত নফল পড়া থেকেও উত্তম। আর যদি যদি সকাল বেলায় গিয়ে ইলমের একটি অধ্যায় শিক্ষা কর, তাহলোে তোমার জন্য তা এক হাজার রাকআত নফল পড়া থেকেও উত্তম। (ইবনে মাজা)
ইলম হাছিল করার পদ্ধতিঃ
সাধারণতঃ তিন পদ্ধতিতে ইলম হাছিল করা যায়।
- (এক) নিয়মিত কোন উস্তাদ থেকে।
- (দুই) দ্বীনী কিতাবাদি পাঠ করে।
- (তিন) কারও থেকে ওয়াজ নছীহত বা দ্বীনী আলোচনা শুনে কিংবা জিজ্ঞাসাবাদ করে।
এই তিনটি পদ্ধতির প্রত্যেকটির ক্ষেত্রে কিছু নীতিমালা রয়েছে। তা হলোঃ
(এক) উস্তাদ নির্বাচনের নীতিমালাঃ
১. উস্তাদ হক্কানী ব্যক্তি হতে হবে অর্থাৎ, আহলোে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের অনুসারী হতে হবে। কোন বাতিল মতবাদে বিশ্বাসী ব্যক্তিকে উস্তাদ বানানো যাবে না।
২. উস্তাদের চিন্তাধারা ঠিক থাকতে হবে। নতুবা ছাত্রের চিন্তাধারাও সঠিক হয়ে গড়ে উঠবে না।
৩. উস্তাদের মধ্যে ইলম অনুযায়ী আমল থাকতে হবে।
৪. উস্তাদ আদর্শবান ব্যক্তি হতে হবে এবং তার আখলাক-চরিত্র উন্নত মানের হতে হবে।
(দুই) গ্রন্থ পাঠের নীতিমালাঃ
১. কোন দ্বীনী বিষয় শিক্ষা করার উদ্দেশ্যে পাঠ করার জন্য যখন কোন কিতাব (গ্রন্থ) নির্বাচন করতে হবে, তখন সর্ব প্রথম দেখতে হবে কিতাবখানার লেখক নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি কি-না, তিনি ভাল জাননেওয়ালা ব্যক্তি কি-না।
যার লেখা কিতাব পাঠ করে ইলম হাছিল করা হবে তিনিও উস্তাদের পর্যায়ভুক্ত; অতএব পূর্বের পরিচ্ছেদে উস্তাদ নির্বাচনের যে নীতিমালা বর্ণনা করা হয়েছে কিতাখানার লেখক সেই নীতিমালায় উত্তীর্ণ কি-না তা দেখে নিতে হবে।
২. বিজ্ঞ আলেম নন- এমন ব্যক্তির জন্য কোন বাতিলপন্থী ও বাতিল মতবাদে বিশ্বাসী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের লিখিত বই-পত্র পাঠ করা ঠিক নয় এরূপ ব্যক্তিদের জন্য বিধর্মীদের কিতাব যেমন তাওরাত, ইঞ্জীল ইত্যাদি পাঠ করাও জায়েয নয়।
অনেকে যুক্তি দিয়ে থাকেন- আমরা পাঠ করে ভালটা গ্রহণ করব মন্দটা গ্রহণ করব না, তাহলোে কী অসুবিধা?
এ যুক্তি এজন্য গ্রহণযোগ্য নয় যে, ভাল/মন্দ সঠিক ভাবে বিচার করার মত পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব থাকায় তিনি হয়ত মন্দটাকেই ভাল ভেবে গ্রহণ করে বিভ্রান্তি ও গুমরাহী-র শিকার হয়ে যেতে পারেন।
৩. কোন ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ করে কোন বিষয় সন্দেহপূর্ণ মনে হলোে বা অস্পষ্ট মনে হলোে কিংবা ভালভাবে বুঝতে না পারলে দ্বীনী ইল্্য সম্বন্ধে বিজ্ঞ আলেম ব্যক্তি থেকে সেটা ভালভাবে বুঝে নিতে হবে।
৪. অনেকে দু’চারখানা দ্বীনী পুস্তক পাঠ করেই দ্বীন সম্পর্কে ইজতেহাদ বা গবেষণা শুরু করে দেন, অথচ ইজতেহাদ বা গবেষণা করার জন্য যে শর্ত সমূহ এবং পর্যাপ্ত জ্ঞানের প্রয়োজন তা তার মধ্যে অনুপস্থিত। এটা নিতান্তই বালখিল্যতা।
নিজের অজানার বহর সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার কারণেই এরূপ মতি বিভ্রাট ঘটে থাকে। এরূপ লোকের গ্রন্থ পাঠ গুমরাহী-র কারণ হতে পারে।
৫. গ্রন্থের মধ্যে কোথাও কোন মাসআলা বা বর্ণনা যদি নিজেদের মাযহাবের খেলাফ মনে হয়, তাহলোে সে অনুযায়ী আমল করা যবে না।
জানার জন্য সেটা পড়া যাবে, কিন্তু আমল করতে হবে নিজেদের ইমামদের মাযহাব ও মাসায়েল অনুযায়ী। প্রয়োজন বোধ হলোে নিজেদের মাযহাব সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিজ্ঞ আলেম থেকে জেনে নেয়া যাবে। (মাযহাব অনুসরণ অন্য পোষ্টে বিসআরিত আলোচনা করা আছে।)
৬. দ্বীনী কিতাব (গ্রন্থ)-এর আদব রক্ষা করতে হবে। দ্বীনী কিতাবাদি নীচে রেখে উপরে শয়ন করা বা উপরে বসা থেকে বিরত থাকাই আদব।
(তিন) ওয়াজ-নছীহত বা দ্বীনী আলোচনা শোনার নীতিমালাঃ
১. সর্ব প্রথম দেখতে হবে তার আকীদা-বিশ্বাস ও চিন্তাধারা সহীহ কি-না এবং তিনি হকপন্থী কি-না। নিজের জানা না থাকলে কোন আলেম থেকে তার সম্পর্কে জেনে নিতে হবে।
২. জেনে নেয়ার পরও তার কোন বক্তব্য সন্দেহপূর্ণ মনে হলোে কোন বিজ্ঞ আলেম থেকে সে সম্পর্কে তাকীক করে নিতে হবে। তাকীক করার পূর্বে সে অনুযায়ী আমল করা যাবেনা বা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করা যাবে না।
ইলম হাছিল করার জন্য যা যা শর্ত ও করণীয়ঃ
১. নিয়ত সহীহ করে নিতে হবে অর্থাৎ, আমল করা ও আমল করার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার নিয়তে ইলম হাছিল করতে হবে। জ্ঞান অর্জন করে মানুষের সঙ্গে তর্কে বিজয়ী হওয়া বা অহংকার প্রদর্শন কিংবা সম্মান অর্জন প্রভৃতি নিয়ত রাখা যাবে না।
২. কিছু জানি না- এরূপ মনোভাব নিয়ে ইল্স সন্ধানে থাকতে হবে। জানার জন্য আগ্র এবং মনে ব্যাকুলতা থাকতে হবে।
আমি অনেক জানি- এরূপ মনোভাব নিয়ে বসলে সেই মনে নতুন ইল্ম ঢুকবেনা। তবে হাঁ এর অর্থ এ নয় যে, বিনা বিচারেই সকলের সব কথা গ্রহণ করতে হবে। বরং কোন বিষয় সন্দেহপূর্ণ মনে হলোে অবশ্যই তা তাকীক করে নিতে হবে।
৩. দ্বীনী ইল্মের আজমত সম্মানবোধ অন্তরে রাখতে হবে। এই ইলম শিক্ষা
করে কী হবে- এরূপ হীনমন্যতা পরিহার করতে হবে।
৪. গোনাহ থেকে মুক্ত থাকতে হবে। কেননা পাপীদের অন্তরে সঠিক ইল্ম প্রবেশ করে না।
৫. উস্তাদ ও কিতাবের আদব রক্ষা করতে হবে। উস্তাদের সাথে সুসম্পর্ক রাখতে হবে এবং উস্তাদের হক আদায় করতে হবে। (এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলাদা পোষ্ট আছে।)
৬. উস্তাদের জন্য দোয়া করতে হবে। কিতাব পাঠ করে জ্ঞান অর্জন করা হলোে সেই কিতাবের লেখকের জন্যও দোয়া করা কর্তব্য।
৭. ইল্মের জন্য মেহেনত করতে হবে।
৮. যতক্ষণ পর্যন্ত কোন বিষয় পরিষ্কার ভাবে বুঝে না আসে, ততক্ষণ পর্যন্ত বার বার উস্তাদকে জিজ্ঞাসা করে কিংবা বার বার পড়ে সেটা পরিষ্কার করে নিতে হবে।
৯. ইলম বৃদ্ধির জন্য এবং ভালভাবে বুঝে আসার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হবে।
১০. ইল্ম অর্জন করে এই ইলম অন্যকে শিক্ষা দেয়া এবং এই ইলম অনুযায়ী আমল করার জন্য অন্যকে দাওয়াত দেয়ার নিয়তও রাখতে হবে।
পোষ্টটি লিখতে নিম্নক্তো বই/লেখকের লিখনী থেকে সাহায্য নেওয়া হয়েছে: আহকামে জিন্দেগী (মাকতাবাতুল আবরার প্রকাশনী) মাওলানা মুহাম্মদ হেমায়েত উদ্দীন শায়খুল হাদীস, জামেয়া ইসলামিয়া আরার্বিয়া, তাঁতী বাজার, ঢাকা-১১০০ মুহাদ্দিছ, জামিয়া ইসলমিয়া দারুল উূলুম মাদানিয়া, ৩১২, দক্ষীণ যাত্রাবাড়ি, ঢাকা-১২৩৬